বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ২৫ বৈশাখ, ১২৬৮ বঙ্গাব্দ, (Rabīndranāth Ṭhākur or Rabindranath Tagore born- 7 May, 1861 AD) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে অর্থাৎ কলকাতার এক সমৃদ্ধ ও সংস্কৃতিবান ব্রাহ্মণ পরিবারের জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মাতা হলেন সারদা সুন্দরী দেবী।
চলো পড়ি, মজার কিছু জানি:-
- ভূমিকা/সূচনা
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছদ্মনাম
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনী
- শৈশব ও কৈশোর কাল
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যৌবন
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাবলী (নাটক, প্রবন্ধ ও পত্রসাহিত্য, উপন্যাস, ছোটোগল, কবিতা)
- চিত্রকলা/ছবি
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পারিবারিক ইতিহাস
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের গোপন প্রেম
- বিশ্বভ্রমণ
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজনৈতিক মতাদর্শ ও শিক্ষাচিন্তা
- প্রভাব
ভূমিকা :- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছিলেন অগ্রণী বাঙালি কবি। তিনি অনেক কিছুতেই যেমন উপন্যাসিক ,সংগীত স্রষ্টা, নাট্যকার ,চিত্রকর ,ছোটগল্পকার ,প্রাবন্ধিক অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী, দার্শনিক বিষয়ে তিনি ছিলেন পারদর্শী। এক কথায় তাকে আমরা বলতে পারি তিনি ছিলেন একজন বিশ্ব ভারতীয় জনপ্রিয় বা বিখ্যাত কবি। এমনকি রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব, কবিগুরু ও বিশ্বকবি অভিধায় ভূষিত করা হয়।
◆ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছদ্মনাম :- বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বাবা-মায়ের ১৪ তম সন্তান ছিলেন। এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যিনি রবীঠাকুরের নামটি শুনেননি। বাংলা সাহিত্য জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ বলে যদি কেউ থেকে থাকেন তাহলে সেটা অবশ্যই কবিগুরু বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ছদ্মনাম ছিল, সেটি হল ভানুসিংহ ঠাকুর (ভণিকা)।
![]() |
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর |
◆ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনী:-
১| শৈশব ও কৈশোর কাল (১৮৫১-১৮৭৮):- ১৮৭৫ সালে মাত্র ১৪ বছরে বয়সে রবীন্দ্রনাথের মাতৃ বিয়োগ ঘটে। পিতা দেবেন্দ্রনাথ দেশ ভ্রমণের নেশায় বছরের অধিকাংশ সময় কলকাতার বাইরে অতিবাহিত করতেন। তাই ধোনির পরিবারের সন্তান হয়েও রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা কেটেছিল ভৃত্যদের অনুশাসনে। শৈশবে রবীন্দ্রনাথ কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্ম্যাল স্কুল, বেঙ্গল একাডেমি এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে যথাকালীন পড়াশোনা করেছিলেন। কিন্তু বিদ্যালয় শিক্ষায় অনাগ্রহী হওয়ায় বাড়িতেই গৃহশিক্ষক রেখে তাঁর শিক্ষা ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ছেলেবেলায় রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকো বাড়িতে অথবা বোলপুর ও পানিহাটির বাগানবাড়িতে প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে ঘুরে বেড়াতো বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
১৮৭৩ সালে 11 বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের উপনয় (যজ্ঞসূত্র ধারণ) অনুষ্ঠিত হয়েছ। এরপর তিনি কয়েক মাসের জন্য পিতার সঙ্গে দেশভ্রমনে বের হন। প্রথমে তারা এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে। এরপর পাঞ্জাবের অমৃতসরে কিছুকাল কাটিয়ে শিখদের উপাসনা পদ্ধতি পরিদর্শন করেন। শেষে পুত্রকে নিয়ে দেবেন্দ্রনাথ যান পাঞ্জাবের ডালহৌসি শৈল (অধুনা ভারতের হিমাচল প্রদেশ রাজ্যে অবস্থিত) শহরের নিকট বক্রোটায়। এখানকার বক্রোটা বাংলোয় বসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পিতার কাছ থেকে সংস্কৃত ব্যাকারণ, ইংরেজী, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান ও ইতিহাসের নিয়মিত পাঠ নিতে শুরু করেন। দেবেন্দ্রনাথ তাকে বিশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গের জীবনী, কালিদাস রচিত ধ্রুপদি সংস্কৃত কাব্য ও নাটক এবং উপনিষদ্ পাঠেও উৎসাহিত করতেন। ১৮৭৭সালে ভারতী পত্রিকায় তরুণ রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা প্রকাশিত হয়। এগুলি হল মাইকেল মধুসূদনের “মেঘনাদবধ” কাব্যের সমালোচনা, ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী এবং “ভিখারিনী” ও “করুণা” নামে দুটি গল্প। এর মধ্যে ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
২) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যৌবন (১৮৭৮-১৯০১):- ১৮৭৮ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডে যান রবীন্দ্রনাথ। প্রথমে তিনি ব্রাইটনের একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন।
১৮৭৯ সালে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন এ আইনবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু সাহিত্যচর্চার আকর্ষণে সেই পড়াশোনা তিনি সমাপ্ত করতে পারেননি। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন শেকসপিয়র অন্যান্য ইংরেজ সাহিত্যিকদের রচনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে। এসময় তিনি বিশেষ মনোযোগ সহকারে পাঠ করেন রিলিজিও মেদিচি, কোরিওলেনাস এবং অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা। এই সময় তার ইংল্যান্ডবাসের অভিজ্ঞতার কথা ভারতী পত্রিকায় পত্রাকারে পাঠাতেন রবীন্দ্রনাথ। উক্ত পত্রিকায় লেখা এই লেখাগুলি জেষ্টভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমালোচনা সহ প্রকাশিত হত “য়ুরোপযাত্রী কোনো বঙ্গীয় যুবকের পত্রধারা”(Letters from an Expatriate in Europe) নামে। ১৮৮১সালে সেই পত্রাবলী “য়ুরোপ-প্রবাসীর” পত্র নামে গ্রন্থাগারে ছাপা হয়। এটিই ছিল তার প্রথম গদ্যগ্রন্থ তথা প্রথম চলিত ভাষায় লেখা গ্রন্থ। অবশেষে ১৮৮০ সালে প্রায় দেড় বছর ইংল্যান্ডে কাটিয়ে কোনো ডিগ্রি না নিয়ে এবং ব্যারিস্টারি পড়া শুরু না করেই তিনি দেশে ফিরে আসেন।
9 December, 1883 (২৪ অগ্রাহায়ন, ১২৯০ বঙ্গাব্দে ) ঠাকুরবাড়ির অধিনস্ত কর্মচারী বেণীমাধব রায়চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিবাহিত জীবনে ভবতারিণী-এর নামকরণ করা হয়েছিল
মৃণালিনী দেবী (১৮৭৩–১৯০২ )।
![]() |
মৃণালিনী দেবী (১৮৭৩–১৯০২ ) |
◆ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাবলী :- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাত্র আট বছর বয়স থেকে কবিতা লেখা শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথের রচনা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে। রবীন্দ্রনাথের প্রকাশিত মৌলিক কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ছিল মোট ৫২ টি কবিতা, ৩৮ টি নাটক, ১৩ টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন তার জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয় তার সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প ও ১৯১৫টি গান। যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ গীতবিতান সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খন্ডে “রবীন্দ্র রচনাবলী” নামে প্রকাশিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় পত্রসাহিত্য উনিশ খন্ডে চিঠিপত্র চারটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত। এছাড়া তিনি প্রায় ২০০০টি ছবি একেঁছিলেন।
১) নাটক : রবীন্দ্রনাথের নাটক বিশ্ব বিখ্যাত তা আমরা সবাই জানি। তিনি মোট ৩৮ টি নাটক রচনা করেন। তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাটক হল --
- শারদোৎসব (১৯০৮)
- রাজা (১৯১০)
- ডাকঘর (১৯১২)
- অচলায়তন (১৯১২)
- ফাল্গুনী (১৯১৬),
- মুক্তধারা (১৯২২)
- রক্তকরবী (১৯২৬)
- কালের যাত্রা (১৯৩২)
- তাসেরদেশ (১৯৩৩)
২) প্রবন্ধ ও পত্রসাহিত্য :- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেন। কবি তার এইসব প্রবন্ধে সমাজ, রাষ্ট্রনীতি, ধর্ম, সাহিত্যতত্ত্ব, ইতিহাস, ভাষাতত্ত্ব, ছন্দ, সংগীত ইত্যাদি নানান বিষয়ে নিজেস্ব মতামত প্রকাশ করেন। জ্যোতিবির্জ্ঞান বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ‛বিশ্বপরিচয়’ (১৯৩৭) নামে একটি তথ্যমূলক প্রবন্ধ রচনা করেন। এরপর ‛জীবনস্মৃতি’ (১৯১২), ‛ছেলেবেলা’ (১৯৪০), ও ‛আত্মপরিচয়’ (১৯৪৩) তার আত্মকথামূলক গ্রন্থ এবং কবির দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রক্ষাপটে লেখা জন্মদিনের অভিভাষণ ‛সভ্যতার সংকট’ (১৯৪১) তার সর্বশেষ প্রবন্ধ গ্রন্থ।
৩) উপন্যাস :- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মোট তেরোটি উপন্যাস রচনা করেছিলে। রবীন্দ্রনাথের উল্লেখযোগ্য উপন্যাস গুলি হল --
- বৌ-ঠাকুরাণীর হাট (১৮৮৩)
- রাজর্ষি (১৮৮৭)
- চোখের বালি (১৯০৩)
- নৌকাডুবি (১৯০৬)
- প্রজাপতির নির্বন্ধ (১৯০৮)
- গোরা (১৯১০)
- ঘরে বাইরে (১৯১৬)
- চতুরঙ্গ (১৯১৬)
‛বৌ-ঠাকুরানীর হাট’ ও ‛রাজর্ষি’ ঐতিহাসিক উপন্যাস হল রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপন্যাস রচনার প্রচেষ্টা।
৪) ছোটোগল্প :- রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম একজন সার্থক ছোটোগল্পকার। মূলত তিনি হিতবাদী, সাধনা, ভারতী, সবুজ পত্র প্রভৃতি মাসিক পত্রিকা গুলির চাহিদা মেটাবার জন্য ছোটোগল্প গুলি রচনা করেন। তার এই ছোটোগল্পগুলি ছিল উচ্চ সাহিত্য মূল্য সম্পন্ন। তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছোটোগল্প হল। যথা-কঙ্কাল
- নিশীথে
- মণিহারা
- ক্ষুধিত পাষাণ
- স্ত্রীরপত্র
- নষ্টনীড়
- কাবুলিওয়ালা
- হৈমন্তী
- ‛সোনারতরী’ (১৮৯৪)
- ‛চিত্রা’ (১৮৯৬)
- ‛চৈতালি’ (১৮৯৬)
- ‛কল্পনা’ (১৯০০)
- ‛ক্ষণিকা’ (১৯০০)
- গীতাঞ্জলি(১৯০০)
- খেয়া(১৯০৬)
- গীতিমাল্য(১৯১৪)
- গীতালি(১৯)
![]() |
গীতাঞ্জলি, শিরোনাম পৃষ্ঠা |
তার সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য সুপরিচিত কাব্যগ্রন্থ হল গীতাঞ্জলি। তিনি এই বইটির জন্য নোবেল পুরস্কার পান। আরো ইত্যাদি কবিতা রয়েছে। এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের শেষ কবিতা ছিল - ‛তোমার সৃষ্টির পথ’ মৃত্যুর আট দিন আগে কবি মৌখিক ভাবে রচনা করেছিলেন।
৬) চিত্রকলা/ছবি :- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়মিত ছবি আঁকা শুরু করলেন প্রায় সত্তর বছর বয়স থেকে। চিত্রাঙ্কনে কোনো প্রথাগত শিক্ষা কবির ছিল না। প্রথমে তিনি হিজিবিজি কাটাকুটিগুলিকে একটি রুপ দেওয়ার চেষ্টা করতে। এই প্রচেষ্টা থেকেই কবিগুরুর ছবি আঁকার সূত্রপাত ঘটে। তিনি ১৯২৮ থেকে ১৯৩৯ কালপরিধিতে অঙ্কিত তার স্কেচ ও ছবির সংখ্যা ছিল প্রায় আড়াই হাজার ও বেশি। রবীন্দ্রনাথ ছবিতে রং ও রেখার সাহায্যে রবীন্দ্রনাথ সংকেতের ব্যবহার করতেন। তিনি মূলত কালি-কলমে আঁকা স্কেচ, জলরংও দেশজ রঙের ব্যবহার করে ছবি আঁকতেন। তার ছবিতে দেখা যায় মানুষের মূখের স্কেচ, অনির্ণেয় প্রাণীর আদল, ফুল, পাখি ইত্যাদি। নন্দনতাত্ত্বিক ও বর্ণ পরিকল্পনার দিক থেকে তার চিত্রকলা ছিল বড়ই অদ্ভূত। তবে রবীন্দ্রনাথ একাধিক অঙ্কলশৈলী রপ্ত করেছিলেন।
◆ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পারিবারিক ইতিহাস:- রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় ছিল ঠাকুর পরিবার। ঠাকুরের আদি পদবী ছিল ‛কুশারী’'। কুশারীরা ছিলেন ভট্টনারায়ন এর পুত্র দীন কুশারীর বংশ জাত। দীন কুশারী মহারাজ ক্ষিতিশূরের নিকট কুশ (বর্ধমান জেলা ) নামক এক গ্রাম পেয়ে গ্রামীণ হন এবং কুশারী নামে পরিচিত হন।
দীন কুশারীর অষ্টম কি দশম পুরুষ এর পরে জগন্নাথ পরবর্তীকালে কুশারীরা ছড়িয়ে পড়েছিলেন বঙ্গদেশের সর্বত্র- যশোরের ঘাটভোগ-দমুরহুদা থেকে ঢাকার কয় কীর্তন থেকে বাঁকুড়ায় সোনামুখী থেকে খুলনার পিঠাভোগ। এর এরপর থেকেই পিঠাভোগের কুশারীরাই হয়ে উঠল সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী ও অবস্থাপন্ন।
◆রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের গোপন প্রেম:- সবার জীবনে প্রেম আসে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও এর ব্যতিক্রম নন। কবিগুরুর জীবনে অনেক নারী এসেছিলেন যারা কবিগুরুর মনে গভিরভাবে দাগ কেটেছিলেন। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন কবির সাহিত্যিক প্রতিভা বিকাশে বিশাল ভূমিকা রেখেছিলেন। এদের মধ্যে দুজন নারীর সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল। যথা-
১) আন্না তড়খড়:- মুম্বাই থাকাকালীন জানা যায় প্রথম প্রেমে পড়েন রবীন্দ্রনাথ।
তখন মুম্বাইয়ে নাম ছিল বোম্বাই। মুম্বাইয়ের এই প্রেমিকা ছিলেন একজন মারাঠি কন্যা। তার নাম অন্নাপূর্ণা তড়খড় বা সংক্ষেপে আন্না। এই প্রেম খুব অল্প সময়ের জন্য চিরস্থায়ী ছিল। তবুও এই প্রেম ছিল কবির জীবনে বেশ তাৎপর্যময়।
কেননা এটি কবি জীবনে প্রথম প্রেম ছিল। তখন কবি কৈশোর পেরিয়ে সবে যৌবনে পা দিয়েছে। আন্না ছিলেন বিদুষী এবং বুদ্ধিমতী। এই মারাঠি কন্যা কবির কাছ থেকে ভালোবেসে একটি ডাকনাম চেয়েছিলেন। কবি "নলিনী" নামটি তার কাব্য ভাবনা থেকে শুধুমাত্র তার জন্যই বুঝি তুলে এনেছিলেন। সেই নাম পেয়ে আন্না বলেছিলেন, “কবি,তোমার গান শুনলে আমি বোধহয় মৃত্যুশয্যায় শায়িত থাকলেও প্রাণ পেয়ে জেগে উঠতে পারি।”
'নলিনী' নামটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খুব প্রিয় ছিল। কবির প্রথম জীবনে রচিত বহু কাব্য-গল্প-নাটকে এই নামটি এসেছে বহুভাবে। জানা যায় এই নর-নারী প্রেমের কোন রূপ দিতে পারেননি কারণ কিশোর রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অতি মাত্রায় লাজুক প্রকৃতির।
২) কাদম্বরী :- রবীন্দ্রনাথের জীবনে দ্বিতীয় নারী ছিলেন তার বৌদি কাদম্বরী। কাদম্বরী ছিলেন কবির বড়ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সহধর্মীনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনে বয়ঃসন্ধির সংবেদনশিল সেই দিনগুলিতে তার বৌঠান খুব বেশি প্রভাব ফেলেছিলেন। 'কাদম্বরী' বৌঠানকে বলা হয় রবীন্দ্রনাথের স্থপতি। কিশোর মনে ছাপ ফেলতে কাদম্বরীর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। ওরা দুজনেই ছিলেন সমবয়সী। কবির অনেক সাহিত্য ও কবিতার সৃষ্টি হয়েছিল এই নিঃসঙ্গ, রিক্ত নারিটিকে ঘিরেই।
◆ বিশ্বভ্রমণ:- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মোট বারো বার বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে প্রায় তিনি পাঁচটি মহাদেশের ত্রিশটিরও বেশি দেশ ভ্রমন করেন। যেমন ১৮৭৮ ও ১৮৯০ সালে প্রথম জীবনে দুই বার রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডে জান এবং ১৯১২ সালে আবার ব্যক্তিগত চিকিৎসার জন্য তৃতীয়বার ইংল্যান্ডে গিয়ে 'ইয়েটস' প্রমুখ কয়েকজন ইংরেজি কবি ও বুদ্ধিজীবীদের কাছে সদ্যরচিত গীতাঞ্জলি কাব্যের ইংরেজি অনুবাদ পাট করে শোনান।
![]() |
আলবার্ড আইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর |
১৯২০-২১ সাল নাগাদ কবি ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান। ১৯২৪ সালে কবি চীন সফর করেন। চীন থেকে এরপর জাপানে গিয়ে তিনি জাতীয়তাবাদী বিরোধী বক্তৃতা দেন।
১৯২৪ সালের শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথ পেরু সরকারের আমন্ত্রণে সেদেশে যাওয়ার পথে অসুস্থ হয়ে পরেন। এই অবস্থায় কবি ভিক্টোরিয়া ওকম্পোর আতিথ্যে তিন মাস কাটান।
১৯২৬ সালে বেনিতো মুসোলিনীর আমন্ত্রণে ইতালি সফরে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
১৯২৭ সালে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সহ চারজন সঙ্গীকে নিয়ে কবি দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়া সফরে যান এবং এই সময় তিনি ভ্রমণ করেন বালি, জাভা, কুয়ালামপুর,মালাক্কা, পেনাং, সিয়াম ও সিঙ্গাপুর। এবং ১৯৩০ সালে কবি শেষবার ইংল্যান্ডে যান অক্সফোর্ডে হিবার্ট বক্তৃতা দেওয়ার জন্য।
এরপর তিনি ভ্রমণ করেন জার্মানি, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কবি ১৯৩২ সালে ইরাক এবং পারস্য ভ্রমণ করেছিলেন। এরপর ১৯৩৪ সালে সিংহল(বর্তমান শ্রীলঙ্কা) ভ্রমণে যান কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এটিই ছিল তার সর্বশেষ বিদেশ সফর।
◆ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজনৈতিক মতাদর্শ ও শিক্ষাচিন্তা :- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজনৈতিক দর্শন অত্যন্ত জটিল ছিল। তিনি সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সমর্থন করতেন। কবির ১৮৯০ সালে ‛মানসী’ কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতায় তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাধারার পরিচয় পাওয়া যায়। হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলায় তথ্য-প্রমাণ এবং পরবর্তীকালে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, তিনি গদর ষড়যন্ত্রের কথা জানতেনই না শুধু বরং উক্ত ষড়যন্ত্রে জাপানি প্রধানমন্ত্রী তেরাউচি মাসাতাকি ও প্রাক্তন প্রিমিয়ার ওকুমা শিসেনোবুর সাহায্যও প্রার্থনা করেছিলেন। আবার, ১৯২৫ সালে একটি প্রবন্ধে স্বদেশী আন্দোলনকে "চকরা সংস্কৃতি" বলে বিদ্রুপ করে রবীন্দ্রনাথ কঠোর ভাষায় তার বিরোধিতা করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতবাসীকে অন্ধ বিপ্লবের পন্থা ত্যাগ করে দৃঢ় ও প্রগতিশীল শিক্ষার পন্থাটিকে গ্রহণ করার আহ্বান জানান। তিনি এই ধরনের মতাদর্শ অনেকেই বিক্ষুদ্ধ করে তোলে।
১৯১৬ সালে শেষে সানফ্রান্সিকোয় একটি হোটেলে থাকাকালীন কিছু চরমপন্থী বিপ্লবী রবীন্দ্রনাথেকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ উপস্থিত হওয়ায় তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছিল।
১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ “নাইট উপাধি” বর্জন করেন। "নাইট উপাধি" প্রত্যাখ্যান এর পত্রে তিনি লর্ড চেমসফোর্ডকে লিখেছিলেন,- "আমার এই প্রতিবাদ আমার আতঙ্কিত দেশবাসীর মৌনযন্ত্রণার অভিব্যাক্তি।"
কবির “চিত্ত যেথা ভয় শূণ্য” ও “একলা চলো রে” রাজনৈতিক রচনা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। “একলা চলো রে” গানটি গান্ধীজীর বিশেষ প্রিয় ছিল।
রবীন্দ্রনাথ তার “তোতাকাহিনী” গল্পে বিদ্যালয়ের মুখস্ত-সর্বস্ব শিক্ষাকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেন। ১৯১৭ সালে ১১ অক্টোবর ক্যালিফোর্নিয়ার সান্টা বারবারা ভ্রমণের সময় শিক্ষা সম্পর্কে প্রথাবিরুদ্ধ চিন্তাভাবনা শুরু করেন।
রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন আশ্রমকে দেশ ও ভূগোলের গণ্ডির বাইরে বের করে বিশ্বকে এক সুত্রে বেধে রাখার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। ১৯১৮ সালে ২২ অক্টোবর বিশ্বভারতী নামাঙ্কিত তার এই বিদ্যালয়ের শিলান্যাস করা হয়েছিল। এবং ১৯২২ সালে ২২ ডিসেম্বরে এ বিদ্যালয়টি উদ্বোধন হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীতে কবি সনাতন ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার ব্রহ্মচর্য ও গুরু প্রথার পূর্ণ প্রবর্তন করেছিলেন।
তিনি অনেক অর্থ শিক্ষাক্ষেত্রে ঢেলে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের অধ্যক্ষ ও শিক্ষক হিসাবে ব্যস্ত থাকতেন ও ছাত্রদের ক্লাস নিতেন। এবং বিকেলে ও সন্ধ্যায় ছাত্রদের পাঠ্যপুস্তক রচনা করতেন।
◆ প্রভাব :- বিংশ শতাব্দীর বাঙালি সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব ছিল সর্বশেষ্ঠ। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ তথা দার্শনিক অমর্ত্য সেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে “হিমালয় প্রতিম ব্যক্তিত্ব” ও “গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক ও বহুমাত্রিক সমসাময়িক দার্শনিক” হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী ২৫ শে বৈশাখ ও প্রায়াণবার্ষিকী ২২শে শ্রাবণ, আজও প্রত্যেকটি বাঙালি সমাজে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে পালিত হয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথকে সর্বশ্রেষ্ঠ কবি বলে বর্ণনা করা হয়। এক কথায় বিশ্বে তার প্রভাব অতুলনীয়।
Source:[Wikipedia];[Britannica];[source]
0 মন্তব্যসমূহ