বিশ্বপথিক রাজা রামমোহন রায়
ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ, আধুনিক ভারতের জনক, প্রথম ভারতীয় ধর্মীয়-সামাজিক পুনর্গঠন আন্দোলন ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা করেন তিনি এবং বাঙালি দার্শনিক হিসেবে পরিচিত লাভ করেন রাজা রামমোহন রায়।
সেই সময় হিন্দু বিধবা নারীদের স্বামীর চিতার সঙ্গে সহমরনে যেতে বা আত্মহুতি দিতে বাধ্য করা হত। তিনি সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত হয়েছেন সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত বা বর্জন করার প্রচেষ্টার জন্য।
তৎকালীন রাজনীতি, জনপ্রশাসন, ধর্মীয় এবং শিক্ষাক্ষেত্রে রাজা রামমোহন বিশেষ উল্লেখযোগ্য প্রভাব রাখতে পেরেছিলেন।
২২ মে,১৭৭২ সালে পশ্চিম বাংলার হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামের রামমোহন রায় জন্মগ্রহণ করেন এক সম্ভ্রান্ত ও রক্ষনশীল ব্রাহ্মণ পরিবারে। পিতা রামকান্ত ও মাতা ছিলেন তারণী দেবী। রাজা রামমোহন রায় ছিলেন একজন হিন্দু ধর্মের মহান সংস্কারক, এবং উনিশ শতকের ভারতের নবজাগরণের অগ্রদূত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে "ভারতপথিক" বলে অভিহিত করেছেন। অধ্যাপক দিলীপ কুমার বিশ্বাস আরো একধাপ এগিয়ে তাকে বলেছেন "বিশ্বপথিক"।
![]() |
Raja Ram Mohan Roy |
Table of Content
- রাজা রামমোহন রায়ের জীবনী
- রাজা রামমোহন রায়ের কর্মজীবন
- রাজা রামমোহন ও তার বহুমুখী সংস্কার
- আত্মীয় সভা গঠন
- ব্রাহ্মসমাজ
- সতীদাহ প্রথা বর্জন
- বিলেত ভ্রমণ
- আধুনিক ভারতের শিক্ষা ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান
- সীমাবদ্ধতা
রাজা রামমোহন রায়ের জীবনী :-
ক) শৈশব ও যৌবন :- ২২মে ১৭৭২ সালে হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামের রামমোহন রায় জন্মগ্রহণ করেন এক সম্ভ্রান্ত কুলীন (বন্দ্যোপাধ্যায় ব্রাহ্মণ বংশে) তাঁর বংশে অদ্ভুত বৈপরীত লক্ষ্য করা যায়।
প্রপিতামহ কৃষ্ণকান্ত ফারুখশিয়ারের আমলে বাংলার সুবেদারের আমিনের কার্য করতেন। সেই সূত্রেই 'রায়' পদবীর ব্যবহার বলে অনুমান করা হয়।
কৃষ্ণকান্তের কনিষ্ঠ পুত্র ব্রজবিনোদ রামমোহনের পিতামহ। পিতা রামকান্ত। রামকান্তের তিন বিবাহ। মধ্যমা পত্নী তারিণীর এক কন্যা ও দুই পুত্র : জগমোহন ও রামমোহন। এঁদের বংশ ছিল বৈষ্ণব, কিন্তু রামমোহনের মাতা ছিলেন ঘোর তান্ত্রিক ঘরের কন্যা।
রামকান্ত পৈতৃক এজমালি ভদ্রাসন ছেড়ে পার্শ্ববর্তী লাঙ্গুলপাড়া গ্রামে স্ব-পরিবারে উঠে যান। তাঁর পিতা রামকান্ত রায় ছিলেন বৈষ্ণবী এবং মাতা তারিণী দেবী ছিলেন শাক্ত।
পনেরো-ষোলো বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করে নানা স্থানে ঘোরেন। কাশীতে ও পাটনায় কিছুকাল ছিলেন এবং নেপালে গিয়েছিলেন। এর আগে তার সঙ্গে তন্ত্রশাস্ত্রবেত্তা সুপণ্ডিত নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কারের (পরে হরিহরানন্দ তীর্থস্বামী কুলাবধূত নামে পরিচিত) যোগাযোগ হয়।
তিনি আঠারো শতকের ভারতের গতানুগতিক সনাতনী শিক্ষা লাভ করেন। তাঁর বাল্যকালেও প্রথম যৌবনে তিনি হিন্দি ও তার মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও বেশ কয়েকটি প্রাচ্য ভাষা যেমন- আরবি, ফরাসি, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের ব্যুৎপত্তি লাভ করে।
বেদান্তে অনুরাগ নন্দকুমার এর সহযোগিতায় হয়েছিল।
ব্রাহ্ম উপাসনালয় প্রতিষ্ঠায় হরিহরানন্দই তার দক্ষিণ হস্ত ছিলেন। বারানসী থেকে প্রথাগত সংস্কৃত শিক্ষার পর তিনি পাটনা থেকে আরবি ও ফারসি ভাষা শেখেন এবং পরে তিনি ইংরেজি গ্রিক ও হিব্রু ভাষা শেখেন।
প্রাশ্চ ও পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞানে তার সমান পারদর্শী ছিল।
১৮৩৭ সাল পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকারের রাজস্ব আদায় ও বিচারকার্য পরিচালনা সরকারি কার্যনির্বাহীর ভাষা হিসেবে ফরাসি প্রচলিত ছিল।
আরবি ভাষার মাধ্যমে প্রাচীন গ্রীক দর্শনশাস্ত্র ও বিজ্ঞান যেমন অ্যারিস্টোটলের যুক্তিবিদ্যা ও ইউক্লিডের মূলনীতি সমূহের প্রাথমিক পর্যায়ের সাথে রামমোহনের পরিচয় ঘটে। অল্প বয়স থেকেই তিনি মূর্তিপূজা হিন্দু ধর্মের অনুষ্ঠানে সমালোচক হয়ে ওঠে।
খ) শেষ জীবন :- রামমোহন রায় ১৮৩১ সালে মুঘল সাম্রাজ্যের অগ্রদূত হিসেবে যুক্তরাজ্য ভ্রমণ করেন। রাজা রাম মোহন ফ্রান্সও পরিদর্শন করেছিলেন। মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হয়ে ২৭ সেপ্টেম্বর ১৮৩৩ সালে (৬১বছর) ব্রিস্টলের কাছে স্টেপল্ টনে মৃত্যুবরণ করেন। ব্রিস্টলে আর্নস ভ্যাল সমাধিস্থলে তাকে কবর দেওয়া হয়েছিল। এবং ১৯৯৭ সালে রাম মোহনের একটি মূর্তি নির্মাণ করা হয়।
রাজা রামমোহন রায়ের কর্মজীবন :-
তরুণ বয়সে রামমোহন রায় কলকাতার মহাজনের কাজ করতেন।১৭৯৬ সালে রামমোহন প্রথম অর্থ উপার্জন করতে শুরু করেছিলেন। ১৮০৩ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী ছিলেন রাম মোহন। রাজা রামমোহন রায় কলকাতায় আসেতেন এবং কোম্পানির নবাগত অসামরিক কর্মচারীদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাদের নানা বিষয়ে সাহায্য করেন। এবং এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে তিনি ভালোভাবে ইংরেজি শিখে নেন।
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাজে সিভিলিয়ান কর্মচারীদের মধ্যে জন ডিগবির সঙ্গে তার সর্বাধিক ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। কোম্পানির কাজে ডিগবির অধীনে রামমোহন দেওয়ান রুপে কাজ করেন ১৮০৩ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত, এই সময়ে তিনি দুবার ভুটানে যান কোম্পানির হয়ে এবং দৌত্যকার্যে ডিগবির সাহচর্যে তার সমস্ত নতুন চিন্তা এই সময়ের মধ্যেই পরিপূর্ণতা লাভ করেন।
১৮১৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে রামমোহন কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা হন। এখন থেকেই প্রকাশ্যে তার সংস্কার প্রচেষ্টার শুরু।
![]() |
রাজা রামমোহন রায়ে |
ভূমিকা অংশে আরবিতে রামমোহন প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ফরাসি ভাষায় লেখা তুহফাতুল মুহাহহিদিন। এই বইটিতে একেশ্বরবাদের সমর্থন আছে। এরপর একেশ্বরবাদ বা ব্রাহ্মবাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য বেদান্ত সূত্র ও তার সমর্থক উপনিষদগুলি বাংলায় অনুবাদ করে প্রচার করতে থাকেন। ১৮১৫ থেকে ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রকাশিত হয় বেদান্তগ্রন্থ, বেদান্তসার, কোনোপনিষদ, ঈশোপনিষদ, কঠোপনিষদ, মান্ডুক্যপনিষদ, মুন্ডকোপনিষদ। রক্ষণ ব্যক্তিরা ক্রুদ্ধ হয়ে তার লেখার প্রতিবাদ দেখাতে লাগলেন এবং এইসব প্রতিবাদ ছিল কটূক্তিপূর্ণ এবং বিদ্বেষ ভাবাপন্ন। রামমোহন ও প্রতিবাদের প্রতিবাদ করলেন যুক্তি দিয়ে ও ভদ্রভাষায়। প্রতিবাদ করে অবিলম্বে থেমে গিয়েছিলেন। "বেদান্ত গ্রন্থ" প্রকাশের সঙ্গে তিনি ব্রহ্মনিষ্ঠ একেশ্বর উপসনার পথ দেখালেন আত্মীয় সভা প্রতিষ্ঠা করে। এই আত্মীয় সভা কে পরে রামমোহন ব্রাহ্মসমাজ নাম এ আখ্যায়িত করেছেন। সাহেবদের বাংলা শেখানোর জন্য তিনি বাংলা ও ইংরেজিতে ব্যাকরণ রচনা করেন।
রাজা রামমোহন ও তার বহুমুখী সংস্কার :-
রাজা রামমোহন রায় কেন বিখ্যাত? রাজা রামমোহন রায় কে ছিলেন?
১) আত্মীয় সভা গঠন :-
অল্প বয়স থেকেই তিনি মূর্তিপূজা ও হিন্দু ধর্মের অন্যান্য আচার-অনুষ্ঠানের কঠোর সমালোচক হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ অনুশীলন করে ও পাশ্চাত্য যুক্তিবাদের সংস্পর্শে এসে রামমোহন উপলব্ধি করলেন একেশ্বরবাদীই হল সকল ধর্মের মূল কথা।
তিনি প্রচার করলেন যে হিন্দু শাস্ত্রে নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা শ্রেষ্ঠ ধর্ম বলে স্বীকৃত। বেদান্ত উপনিষদের উপর ভিত্তি করে রামমোহন একেশ্বরবাদী ধর্মের পুনুরুজ্জীবনে সচেষ্ট হলেন।
ব্রহ্ম সম্বন্ধে আলোচনা জন্য রামমোহন প্রথমে বন্ধুবান্ধব ও অনুগামীদের নিয়ে "আত্মীয় সভা" গঠন করে।
২) ব্রাহ্মসমাজ :-
(বাঙালি ব্রাহ্মণ ব্রাহ্ম সমাজ) হলো ব্রাহ্ম ধর্মের সমাজি উপাদান। যা হিন্দু ধর্মের একেশ্বরবাদী সংস্কারবাদী আন্দোলন হিসেবে শুরু হয়েছিল এবং যা উপস্থিত হয়েছিল রেনেসাঁর সময়। এবং ঊনিশ শতকে স্থাপিত এক সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলন বাংলার পূনর্জাগরণের পুরোধা হিসেবে পরিচিত।
কলকাতায় ২০ আগস্ট, ১৮২৮ খিস্টাব্দে বিশুদ্ধ একেশ্বরবাদের ভিত্তিতে উপাসনার রীতি প্রচারের উদ্দেশ্যে রামমোহন "ব্রাহ্মসমাজ" নামে এক নতুন সভা স্থাপন করেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল "নিরাকার ব্রহ্ম" তাই থেকেই নিজেদের ধর্মের নাম রাখেন ব্রাহ্ম। এই সভায় বেদ, উপনিষদ- পাঠ ও ব্রহ্ম - সংগীত গাওয়া হতো।
এই সভায় একেশ্বরবাদের বিশ্বাসী ও মূর্তিপূজা বিরোধী সব লোকের প্রবেশাধিকার ছিল।
কিন্তু ব্রাহ্মসমাজকে কোন নতুন ধর্ম বলা যুক্তিযুক্ত নয়। এটি প্রধান হিসেবে আজ চর্চা করতে হয় আদি ধর্ম তার অন্ধকার পর বাংলার প্রদর্শন করে প্রস্থান করার অনুবর্তী Tattwabodhini Sabha ১৮৩৯ সালে তার পদমর্যাদা থেকে প্রকাশের পর হেমেন্দ্র নাথ ঠাকুর এর ব্রাহ্ম অনুষ্ঠান ১৮৬০ (অনুশীলনের কোড ) যা আনুষ্ঠানিকভাবে থেকে Brahmaism তালাকপ্রাপ্ত হিন্দু ধর্ম, প্রথম ব্রাহ্মসমাজ ১৮৬১ সালে লাহোরে পন্ডিত নবীন চন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
এটি ভারতের অন্যতম প্রভাবশালী ধর্মীয় আন্দোলন নামে পরিচিত ছিল। এবং আধুনিক ভারত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এটা শুরু হয়েছিল কলকাতার রাজা দ্বারা ২০ আগস্ট ১৮২৫ তে রামমোহন রায় এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়ন্ত্রক সংস্কার যেমন Brahmanism সময় বিশেষভাবে "কুলিন" অনুশীলনগুলো ঊনিশ শতকের হিন্দু সম্প্রদায়ের সমস্ত ধর্মীয়, সামাজিক এবং শিক্ষাগত অগ্রগতির পথিকৃত ঊনিশ শতকের বঙ্গীয় রেনেসাঁ শুরু করেছিল।
১৮৩০ সালে এটি দলিল আনুষ্ঠানিকভাবে তৈরি করা হয়েছিল। এবং ১৮৩০ সালের জানুয়ারিতে এটি প্রথম "ব্রাহ্মসমাজ" নামে পরিচিত। ব্রাহ্মসমাজ থেকে ব্রাহ্মধর্মের সূত্রপাত ঘটে যা ভারত ও বাংলাদেশের আইনত স্বীকৃত ধর্ম গুলির মধ্যে অতি সাম্প্রতিক তম জুডো-ইসলামিক বিশ্বাস ও অনুশীলনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান গুলির সাথে সংস্কারকৃত আধ্যাত্মিক হিন্দু ধর্মের ভিত্তি প্রতিফলিত করে।
রামমোহনের ধর্মীয় সত্য অনুসন্ধানের তৃষ্ণা তাকে উদার মন নিয়ে সকল গুরুত্বপূর্ণ ধর্মের শাস্ত্রসমূহ অধ্যয়নে প্রণোদিত করে। এভাবে তিনি শুধু সংস্কৃত ভাষায় হিন্দু ধর্মশাস্ত্রসমূহ, যেমন বেদ , অধ্যয়ন করেই ক্ষান্ত হননি; তিনি আরবি ভাষায় কুরআন এবং হিব্রু ভাষা ও গ্রিক ভাষায় বাইবেল পাঠ করেন।
বিভিন্ন ধর্ম অধ্যয়ন তার মনে দৃঢপ্রত্যয় জন্মায় যে, যেহেতু প্রত্যেক ধর্মেরই উদ্দেশ্য অভিন্ন, যথা, মানব জাতির নৈতিক পুনর্জাগরণ, তাই পরিবর্তিত সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রত্যেক ধর্মের পুনর্ব্যাখ্যা ও পুর্নমূল্যায়ন প্রয়োজন।
সুতরাং তিনি চিন্তা করে দেখলেন যে, তার পক্ষে হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে অন্য কোন ধর্ম গ্রহণের পেছনে কোন যুক্তি নেই। তিনি প্রত্যেক ধর্মের গোঁড়ামি, শাস্ত্রীয় আচারপালন ও কুসংস্কার বাদ দিয়ে সর্বজনীন নৈতিক উপদেশাবলি গ্রহণ করবেন।
কিছুদিন যাবৎ অনেকটা অন্ধের মতো অবসন্ধানের পর ১৮২৮ সাল নাগাদ তার ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা কিছুটা স্পষ্ট রূপ লাভ করে। ঐ বছরের আগস্ট মাসে তিনি ব্রাহ্ম সভা বা পরবর্তীসময়ে ব্রাহ্ম সমাজ অর্থাৎ ঈশ্বরের সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। এখান থেকে একথা স্পষ্ট যে কুসংস্কারও আচার-অনুষ্ঠান সর্বস্ব হিন্দু ধর্ম সংস্কার সাধন করাই রাজা রামমোহন এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল।
৩) সতীদাহ প্রথা বর্জন :-
ধর্মীয় সংস্কারের পাশাপাশি সমাজ - সংস্কারের দিকেও রামমোহনের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছিল। প্রাশ্চাত্যের উদারনৈতিক ভাবধারার উদ্বুদ্ধ হয়ে রামমোহন দেখলেন কুসংস্কার ও জনত্বের হাত থেকে হিন্দু সমাজকে উদ্ধার করা অত্যন্ত জরুরি।
সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে রামমোহন ছিলেন অগ্রদূত। জাতিভেদ প্রথা ও স্ত্রীজাতির প্রতি বৈষম্য এই দুই সামাজিক গলদের বিরুদ্ধে রামমোহন তীব্র প্রতিবাদ জানান।সমাজ-সংস্কারের ক্ষেত্রে রামমোহনের শ্রেষ্ঠ ঘটনা হলো সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন।
রামমোহন তার "সংবাদ কৌমুদি"নামক পত্রিকার সতীদাহের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করেন। এদেশে পর্তুগীজ, ফরাসি, ও ওলন্দাজ শাসকেরা ইতিমধ্যেই তাঁদের অধিকৃত অঞ্চলে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করেন।
কিন্তু এই প্রথা নিষিদ্ধ করলে হিন্দু সমাজে অসন্তোষের সৃষ্টি হতে পারে, এই আশঙ্কায় ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ কোন পদক্ষেপ নেননি। সতীদাহের বিরুদ্ধে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপক উইলিয়াম কেরি ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এই প্রথা নিবারণ করতে অনুরোধ জানান। এরপর রামমোহনের সহযোগিতার ফলে গর্ভনর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিং সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করেন। রক্ষণশীল সমাজের নেতা রাধাকান্ত দেব এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডে
একটি স্বরকলিপি পাঠান, অন্যদিকে রামমোহন ইংল্যান্ডে 'প্রিভি কাউন্সিল 'এর নিকট সতীদাহের বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক দেখালে সরকারি সিদ্ধান্ত বহাল থাকে। সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে রামমোহন কৌলিন্য প্রথা, বাল্যবিবাহ, স্ত্রীশিক্ষার জন্যও জনমত গঠন করেন।
বিলেত ভ্রমণ :-
রাজা রামমোহন রায় ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৯ নভেম্বরে কলকাতা থেকে বিলের যাত্রা করেন। এবং দিল্লির বাদশাহ দ্বিতীয় আকবর তাকে "রাজা" উপাধি দিয়ে ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে কিছুদিনের জন্য তিনি ফ্রান্সেও গিয়েছিলেন। রাজা রামমোহন ছিলেন আধুনিক ভারতের সমাজ সংস্কারের অন্যতম পথিকৃত।
আধুনিক ভারতের শিক্ষা ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান :-
রাজা রামমোহন রায়কে আধুনিক মানুষ বলা হয় কেন?
রাজা রামমোহন রায় ছিলেন বাংলার নবজাগরণের প্রভাতী তারকা। ঊনিশ শতক যে সময়ে রামমোহন জীবিত ছিল তা ছিল ভারতের এক অন্ধকারময় যুগ। মধ্যযুগের তন্ত্রা জয়তা। অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার তার মানসিকতা ও দৈনন্দিন জীবনকে আচ্ছন্ন করেছিল।
ধর্মের নামে কতগুলো ক্ষতিকারক আচারন তারা পালন করত। জাতীয় এই সংকট জনক সময়ে রাজা রামমোহন ভারতবাসীকে তার অগ্রগতি ও মুক্তির পথ নির্দেশ করেন। রাজা রামমোহন ছিলেন ভারতীয় নবজাগরণের অগ্রদূত।
তাকে "ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ" ও আধুনিক ভারতের জনক প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হয়েছে। সংস্কারক রূপে রামমোহনের কর্মকাণ্ড ছিল বহু ধরনের। ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন এর ক্ষেত্রে তিনি অগ্রণী ভূমিকা নেন।
ডেভিড হেয়ার নামে এক উদারচেতা ইংরেজের সহযোগিতায় বহু স্কুল স্থাপন করেন। ১৮২৪ সালে কলকাতায় সংস্কৃত কলেজ স্থাপনে গর্ভনর জেনারেল লর্ড আমহার্স্ট উদ্যোগী হলে রামমোহন তার তীব্র বিরোধিতা করেন। পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের মাধ্যমে ভারতবাসী অজ্ঞতা ও জড়তা থেকে মুক্তি হতে পারবে এই ছিল তার ধারণা।
রাজনৈতিক চিন্তাধারার ক্ষেত্রও রামমোহন ছিলেন যুগোত্তীর্ণ পুরুষ। ব্রিটিশ শাসনের বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানান। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে সংবাদপত্র বিধি গৃহীত হলে রামমোহনের বিরোধিতা করেন।
কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়েও তিনি সজাগ ছিলেন এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রজা - বিরোধী চরিত্র তুলে ধরেন। এছাড়া, সমর - বিভাগের ভারতীয়করণ, জুরি প্রথা প্রবর্তন ও ফৌজদারি আইন সংকলন প্রভৃতি বিষয়ে সুস্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। তাছাড়া, সমকালীন বিশ্বের দুই যুগান্তরকারী বিপ্লব "আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ" ও "ফরাসি বিপ্লব" রামমোহনকে বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছিল।
ইউরোপীয় যুক্তিবাদী দর্শনকেই তিনি শুধু বরণ করেনি ফরাসি বিপ্লব সজ্জাত "সাম্য - মৈত্রী - স্বাধীনতা" আদর্শও তাঁর চেতনাকে প্রভাবিত করেছিল।
সীমাবদ্ধতা :-
রামমোহনের কর্তৃত্বের মূল্যায়নের পণ্ডিতদের মধ্যে পরস্পর বিরোধ মতামত প্রচলিত আছে তাঁর জীবনদশাতেই অনেকে তার বিরুদ্ধে সমালোচনা করেনি।
ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা, ও আধুনিকতার অগ্রদূত হিসেবে রামমোহন এর সকল কর্তৃত্বকে অস্বীকার করেছেন।
ঐতিহাসিক ডেভিড কফ রামমোহনকে কখনোই "আধুনিক ভারতের জনক" বলতে রাজি নন। তার জীবন ও কর্মে নানা স্ববিরোধিতা দেখা যায়, তার বিরুদ্ধে বলা হয়----
১) হিন্দু - ধর্মের কুসংস্কার, পৌওলিকতা, সতীদাহ প্রকৃতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করলেও তিনি কিন্তু জাতিভেদ প্রথা, বাল্যবিবাহের, বহুবিবাহ, বিরুদ্ধে সেভাবে রুখে দাঁড়াননি। তিনি কখনোই ব্রাহ্মণের উপবীত ত্যাগ করেননি। এবং তার ব্রাহ্মসমাজে ব্রাহ্মন ব্যতীত অপর কেউ আচায্য হতে পারেননি। মৃত্যুর পরে তাকে যেন খ্রিস্টান মতে সমাধি না দেওয়া হয় এ জন্য তিনি বারবার সতর্ক করেছেন।
২) হিন্দু ধর্মের সংস্কার করতে গিয়ে যুক্তি নয় তিনি ধর্মশাস্ত্র গুলোর উপরে নির্ভর করেছেন।
৩) তিনি বেদান্তের ওপর ভিত্তি করে সংস্কার কাজে ব্রতী হন। কিন্তু বেদান্তের "ত্যাগবাদকে" তিনি অনুসরণ করেনি।
৪) ইংরেজি শিক্ষার বিস্তারের পক্ষে বলতে গিয়ে সংস্কৃত ভাষা ও দেশীয় শিক্ষার প্রতি তিনি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন।
৫) ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি যে দেশীয় শিক্ষা ও মাতৃভাষারও প্রসারের প্রয়োজন তা তিনি উপলব্ধি করেননি।
৬) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জনিত কারনে কৃষকদের দুরবস্তার প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি কিন্তু কিছুই বলেননি বা নীলকরদের অত্যাচার সম্পর্কে মুখ খোলেননি।
৭) তিনি অবাধ বাণিজ্যের সমর্থক ছিলেন কিন্তু এর ফলে যে কুটির শিল্প ধ্বংস করছে এ সম্পর্কে কিছু বলেননি।
৮) তার অতিরিক্ত ইংরেজ ও ইংরেজি শিক্ষা প্রীতির জন্য তাকে অনেকে জাতীয়তা বিরোধী বলে মনে করেন।
ড: .এন. এস. বোসের এর মতে, "একথা সত্য যে, রামমোহন সাধারন জনগনের নেতৃত্বদানে বিফল হন এবং তিনি যে আন্দোলন সৃষ্টি করেন জনগণের মধ্যে তার ভিত্তি ছিল দুর্বল"। এইসব বিরূপ সমালোচনার সত্ত্বেও তাকে নিঃসন্দেহে ভারতের অগ্রদূত হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। আমাদের মনে রাখতে হবে তিনি সমাজ সংস্কারক ছিলেন বিপ্লবী নন।
0 মন্তব্যসমূহ