ফরাসি বিপ্লব

ফরাসি বিপ্লব

INDEX :

  • ভূমিকা
  •  ফরাসি বিপ্লবের সময় সীমা
  • ফরাসি বিপ্লবের জনক
  • ফরাসি বিপ্লবের মূলনীতি 
  • ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের অবদান
  • ফরাসি বিপ্লবের জন্য বা সংগঠনের ফরাসি রাজতন্ত্র কতটা দায়ী ছিল 
  • ফরাসি বিপ্লবের রাজতন্ত্রের দায়িত্ব
  • ফরাসি বিপ্লবে সামন্ততন্ত্রের বিলোপ 
  • ফরাসি বিপ্লবের কারণ 
  • সামাজিক কারণ
  •  অর্থনৈতিক কারণ

ভূমিকা :- 

 ফরাসি ইউরোপ ও পশ্চিমা সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ফরাসি বিপ্লব। অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্যায়ে ফ্রান্সে ঘটে যাওয়া ফরাসি বিপ্লব ইতিহাসের পাতায় একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসে এত ব‍্যাপক, গভীর, সুদূর প্রসারী ফরাসি বিপ্লবের মতোএমন বিপ্লব আর ঘটেনি। 

Pharasi-biplaba


 ঐতিহাসিক ডেভিড টমসন বলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ফরাসি বিপ্লবকেই আধুনিক ইউরোপের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে আখ্যায়িত করা হয়। ফ্রান্সে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র এই বিপ্লবের সময়েই বিলুপ্ত হয়ে প্রজাতান্ত্রিক আদর্শের দিকে ধাবিত হয়। এবং একই সময়ে একই সাথে দেশের রোমান ক্যাথলিক চার্চ সকল গোঁড়ামি ত্যাগ করে নিজেকে পূর্ণগঠন করতে এক প্রকার বাধ্য হয়। 

পশ্চিমা গণতন্ত্রের ইতিহাসে ফরাসি বিপ্লবকে একটি জটিল সন্ধিক্ষন হিসেবে অভিহিত করা হয়। যার মাধ্যমে পশ্চিমা সভ্যতা নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র এবং অভিজাততন্ত্র থেকে নাগরিকত্বের যুগে পর্দাপন করে।

 ফরাসি বিপ্লবের সময় সীমা :-

 ৫ মে ১৭৮৯ থেকে ৯ নভেম্বর ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দ । যথা ১০ বছর ৬ মাস এবং ৪ দিন পর্যন্ত এই ফরাসি বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল।

 ফরাসি বিপ্লবের জনক :-

 ষোড়শ লুইকে ফরাসি বিপ্লবের জনক বলা হয়। ষোড়শ লুই ফরাসি বিপ্লবের সময় ফ্রান্সের বুরবো বংশের রাজা ছিলেন। তিনি দৈবস্বত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। 

 ফরাসি বিপ্লবের মূলনীতি :-

 ফরাসি বিপ্লবের মূলনীতি ছিল যথাক্রমে "Liberte, egalite, fraternite, ou la mort;" সুতরাং স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব অথবা মৃত্যু। সহজ ভাষায় স্বাধীনতা, সাম্য, মৈত্রী, ফরাসিদের মনে এই আদর্শ এমনভাবে গাঁথা ছিল যে তারা পরবর্তীতে সকল কর্মে এই আদর্শকেই অনুসরণ করতো। 
ইংল্যান্ড, জার্মানি, প্রাশিয়া, সুইজারল্যান্ড ইত্যাদি দেশে ফরাসি বিপ্লবের আদর্শে সভা-সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এবং ইতালি, জার্মানি, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, অস্ট্রিয়া, গ্রিস ইত্যাদি অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী মুক্তি সংগ্রাম সংক্রমিত হতে থাকে। বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থার আঘাত হানে।   
ফরাসি বিপ্লবের মূল লক্ষ্য হল যোগ্যতার মাধ্যমে সকলের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা। জন্মগত কৌলিন‍্য বাদ দিয়ে যোগ্যতা ও দক্ষতা মানুষের সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এবং ভ্রাতৃত্ববোধের আদর্শ এই বিপ্লবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল সমস্ত বিশ্ববাসীর কাছে। এবং ফ্রান্স ইউরোপের অন্যান্য সহযোগী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত সাহায্য করেছিল। 

 ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের অবদান :- 

 অষ্টাদশ শতকে ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের অবদান ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন দেশের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গড়ে ওঠেনি কিন্তু ফ্রান্সে প্রতিরোধের মনোভাব প্রবল হয়ে উঠেছিল। এর কারণ হলো, ফ্রান্সে বাস্তুতান্ত্রিক দার্শনিক বা ফিলোজফারদের আবির্ভাব। ফরাসি বিপ্লবে কয়েকজন উল্লেখযোগ্য দার্শনিকদের অবদান সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল। যথা -----  

ভলটেয়ার :- 

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও যুক্তিবাদের প্রসারে যে নতুন দিগন্তের সৃষ্টি হয়। সেখানে যিনি প্রধান ভূমিকা পালন করেন তিনি হলেন ফাঁসোয়া - মারি আরোয়েৎ, যিনি ভলটেয়ার নামে অমরত্ব লাভ করেছেন। তিনি অনেক নতুন নতুন ধ‍্যান-ধারণার ব্যাখ্যা করে সেগুলো কে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন।

 প্রধানত ফ্রান্সের ধর্মীয় সংগঠন পদ্ধতি ও অধঃপতিত ধর্মযাজকদের তিনি তীব্র ভাবে আক্রমণ করেন। তিনি মানব ধর্মের জয়গান গেয়েছিলেন এবং ক্ষুরধার যুক্তি প্রয়োগে ধর্মীয় রহস‍্যবাদ ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছিলেন।
 
একজন ঐতিহাসিকের মতে ভলটেয়ারের শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব হচ্ছে যে, স্থায়ী প্রতিষ্ঠানগুলিকে বারবার ধ্বংসাত্মক সমালোচনার দ্বারা আঘাত করে তিনি বিপ্লবপ্রসূত আঘাতের তীব্রতর বোধকে হ্রাস করে দেয়।

মন্টেস্কু :-

ভলটেয়ারের সমসাময়িক আর একজন লেখক হলেন মন্টেস্কু। তিনি ঐতিহাসিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের চর্চা করে যে সিদ্ধান্তে আসেন তা হল এই যে --- কোন শাসন প্রণালী অবস্থা নির্বিশেষে উপযুক্ত নয়। অর্থাৎ, শাসন প্রণালীর চরিত্র নির্ভর করে সেই জাতির চরিত্র এবং বাস্তব পরিবেশের উপর।

মন্টেস্কু ইংরেজ দার্শনিক লকের "সামাজিক চুক্তির " তত্ত্বটিকে অস্বীকার করেন এবং ঘোষণা করেন যে ইংরেজদের ব্যাক্তিস্বাধীনতার প্রধান কারণ হলো যে ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রে শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ, ও বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ পৃথক।

 মন্টেস্কু চেয়েছিলেন ফ্রান্সের জন্য একটি লিখিত সংবিধান যা ফরাসিদের নাগরিক ও ব‍্যাক্তি স্বাধীনতা রক্ষা করবে। বিপ্লবের সময় যারা ফ্রান্সের প্রথম সংবিধান ( ১৭৯১ খ্রিষ্টাব্দ) রচনা করেন তারা মন্টেস্কুর ক্ষমতা বিভাজন নীতির দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। 

মন্টেস্কু ''The Spirit of the Laws'' গ্রন্থটিতে মধ্যযুগীয় শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রবল আপত্তি তুলেছিলেন। তাঁর বলিষ্ঠ মতবাদ ফরাসি জনসাধারণের সামনে একজন এক নতুন আদর্শ স্থাপন করে। 

রুশো :- 

ভলটেয়ার থেকে শুরু করে ফরাসি চিন্তানায়কদের যে দীর্ঘ তালিকা পাওয়া যায় তারা সবাই মোটামুটি প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে তাদের বক্তব্যকে স্থাপন করেন। কিন্তু যে ব্যক্তিটি সম্পূর্ণ নতুন ধরনের কথা ঘোষণা করেন তিনি হলেন জ্যাক রুশো

 তিনি রোমান্টিক মতবাদের প্রথম গুরু যিনি বিজ্ঞানও যুক্তির পরিবর্তে অনুভূতি এবং সহজাত প্রবৃত্তির উপর সার্বিক গুরুত্ব আরোপ করেন। তার মতে রাজার ক্ষমতা কোন প্রকারেই জনগণের ক্ষমতা থেকে বড় নয়। ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে তার অসাধারণ গ্রন্থ "সামাজিক চুক্তি " প্রকাশিত হয়।

 এই কালজয়ী গ্রন্থে তিনি প্রধানত দুটি মনোজ্ঞ আলোচনা করেন। প্রথম তত্ত্ব 'সাধারণ ইচ্ছা ' য় তার বক্তব্য ছিল এই যে, কর্তার ইচ্ছায় কর্ম হয়না। রাজা ও প্রজার সম্মিলিত ফলশ্রুতি হল রাষ্ট্র। রাজা শুধু নিজের ক্ষমতার কর্তা সেজে একাকী কোন কাজ করতে পারেন না। 

তার মতে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব এক এবং অবিভাজ‍্য। সেই সার্বভৌমত্ব আসলে প্রজাদের সার্বভৌমত্ব- রাজার নয়। রাজা রাষ্টের ভৃত‍্য মাত্র। রুশোর দ্বিতীয় তত্ত্ব ছিল সামাজিক চুক্তি তত্ত্ব। তাঁর মতে স্মরণাতীতকালের প্রজাদের মধ্যে একটি চুক্তির ফলশ্রুতি হলো রাজ শাসিত রাষ্ট্র। রাজার ঐশ্বরিক অধিকারের দাবি ভিত্তিহীন এবং হাস্যকর।

 তিনি দৃপ্ত ভাষায় ঘোষণা করেন, স্বাধীন অবস্থায় মানুষের জন্ম হলেও সর্বত্র শৃঙ্খলিত এই শৃঙ্খল ভাঙবার বৈপ্লবিক অনুপ্ররনা তিনি সৃষ্টি করেছিলেন। প্রচলিত বিধিব্যবস্থা প্রতি অনাস্থা, স্বেচ্ছাচারী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, দায়িত্বশীল সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা, গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা, গণতান্ত্রিক শিক্ষা প্রভৃতি বিষয় গুলি ফ্রান্সের শিক্ষিত জনসাধারণ দার্শনিকদের রচনা থেকে গ্রহণ করেছিলেন। 

সুতরাং ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের অবদান বা ভূমিকা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। 

ফরাসি বিপ্লবের জন্য বা সংগঠনের ফরাসি রাজতন্ত্র কতটা দায়ী ছিল :-

ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার ক্ষেত্রে তৎকালীন ফ্রান্সের বুরবোঁ রাজতন্ত্র সবচেয়ে বেশি দায়ী ছিল। ফ্রান্সের সবচেয়ে শক্তিশালী বুরবোঁ রাজা চতুর্দশ লুইয়ের আমল (১৬৪৩ - ১৭১৫ খ্রিষ্টাব্দ) থেকে ফ্রান্সে যে স্বৈরাচার শুরু হয় তার ফলেই ফরাসিবাসী বিপ্লবের রাস্তায় যেতে বাধ্য হয়। আসলে যুগের প্রয়োজনে নিজেদেরকে পরিবর্তিত না করার ইতিহাস ফরাসি বিপ্লবের জন্য বুরবোঁ রাজতন্ত্রকে দায়ী করেছে।



 ঐতিহাসিক মাদেলাঁ ফরাসি বিপ্লবের জন্য বুরবোঁ রাজতন্ত্রকে দায়ী করে বলেছেন, "The Franch monarchy which made the revolution,"। ফরাসি রাজতন্ত্র একটি নিরঙ্কুশ স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রেরই নামান্তর ছিল।

  States Genarel নামক প্রতিনিধি সভার নামতন্ত্র অস্তিত্ব থাকলেও ১৭৫ বছর তার কোন অধিবেশন থাকে না বসায়, রাজা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠেন। ফরাসি রাজা নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে প্রচার করেন। চরম ক্ষমতাশীল শাসক সর্বোচ্চ বিচারক ও আইন প্রণীতারূপে রাজা রাষ্ট্রের প্রকৃত নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন। চতুদর্শ লুই বলেন "আমিই রাষ্ট্র " (I am the State)। 

ফরাসি বিপ্লবের রাজতন্ত্রের দায়িত্ব :- 

 ফরাসি বিপ্লবের ফরাসি রাজতন্ত্র বা বুরবোঁ রজতন্ত্রের দায়িত্বগুলো ছিল ---

 ১) প্রশাসনিক দুর্নীতি :- 

 বুরবোঁ রাজতন্ত্র বিভিন্ন প্রকার প্রশাসনিক দুর্নীতির জন্য দায়ী ছিল। বিনা বিচারে গ্রেফতার ও কারাদণ্ড লেটারসডি কেসের দ্বারা বিনা বিচারে আটক, ব্যাক্তিস্বাধীনতা বিনাশ, পক্ষপাতদুষ্ট বিচার ব্যবস্থা, প্রজাদের আবেদনের প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা না করা প্রভৃতি বিভিন্নভাবে বুরবোঁ শাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি শিকড় বিস্তার লাভ করে। 

কোনো  একটি গৃহ নির্মাণের জন্য সাধারণত একটি দরখাস্ত সরকারি দপ্তরে জমা পড়লে বছরের পর বছর তা চাপা পড়ে থাকত। সরকারি কর্মচারীরা ছিল দুর্নীতিপূর্ন, অত‍্যাচারী ও জনস্বার্থবিরোধী। পঞ্চদশ ও ষোড়শ লুই কেউই প্রশাসনকে কার্যকরী ও ন‍্যায় পরায়ন করার কোনো চেষ্টা করেননি। 

 ২) পঞ্চদশ ও ষোড়শ লুই এর অযোগ্যতা :- 

 পঞ্চদশ লুই এর আমল থেকে শাসনব্যবস্থায় গলদ বৃদ্ধি পায় ও শিথিলতা বাড়ে। " Sun Kng" চতুর্দশ লুই ছিলেন যেমন যোগ্য তেমনই পরিশ্রমী। তিনি মন্ত্রী ও কর্মচারীদের পরিচালনা করার ক্ষমতা রাখতেন । কিন্তু পঞ্চদশ লুই ছিলেন, ঐতিহাসিক সেভিলের ভাষায় "প্রজাপতি রাজা"

তিনি আমোদ-প্রমোদ,সুন্দরী রমণীদের সঙ্গে সময়ক্ষেপ করতেন।তার স্থায়ী উপপত্নী মাদামদ‍্যাপম্পাদ‍্যুর পঞ্চদশ লুই এর দুর্বলতার সুযোগে রাজকার্যে অংশগ্রহণ হস্তক্ষেপ করতেন। পঞ্চদশ লুই সরকারি কাজের জন্য কোন পরিশ্রম করতেন না। এইজন‍্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত ও পরিচালনা প্রভাবশালী মন্ত্রী ও অভিজাতদের ওপর চলে যায়। 

ঐতিহাসিক সেভিলের মতে, রাজার নাম করে অভিজাতরা প্রশাসন চালাতে থাকে। ষোড়শ লুই ছিলেন উন্নতম ও সৎ স্বভাবের লোক। কিন্তু ষোড়শ লুই এর চরিত্রে কোনো দৃঢ়তা ছিল না। তিনি কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে অপারক ছিলেন। ষোড়শ লুই এতই ভালো মানুষ ছিলেন যে তিনি অভিজাত কর্মচারী এমনকি তাঁর পত্নীকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেতেন না।

তার পত্নীও দরবারের প্রভাবশালী গোষ্ঠীর চাপে তিনি বিখ্যাত সংস্কারবাদী মন্ত্রী "টুরগো" কে পদচ্যুত করেন। যদিও ষোড়শ লুই টুরগোকে বিদায় দেবার সময় আক্ষেপ করে বলেন যে, "কেবলমাত্র টুরগো ও আমি ফ্রান্সকে ভালোবাসি" যদি ষোড়শ লুই দৃঢ়তা দেখাতেন তবে বিপর্যয় এড়ানো যেত। 

 ৩) রাজপরিবারের অমৃতব্যায়িতা :- 

 রাজপরিবারের সীমাহীন বিলাসব্যসন উৎশৃঙ্খলা ও অমৃতব‍্যাহিতা দেশের অর্থনীতি ও জনমনের এক ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। ভাষ‍্যায়ের রাজপ্রাসাদ ছিল বিলাস ব‍্যাসন ও ঐশ্বর্য ইন্দ্রপুরী, রাজপরিবারের সেবার জন্য ১৮০০০ কর্মচারী সর্বদা নিয়োজিত ছিল। ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ভার্সাই রাজপ্রাসাদে বিলাসের জন্য ব্যয় হয়েছিল ২ কোটি মুদ্রা। 

রাজা, রানী তার সন্তান- সম্পত্তি এবং অগনীত আত্মীয়-স্বজন সকলের জন্য পৃথক পৃথক সুরম‍্য অট্টালিকা ছিল। রানী মেরীর আঁতোয়ানেত এর ব্যক্তিগত সংখ্যাছিল ৫০০ রাজপরিবারের প্রমোদ ভ্রমণের জন্য সর্বদা ২০০০ ঘোড়া এবং ২০০ শকট প্রস্তুত থাকত। রাজপরিবারের এই অমৃতাব‍্যয়িতা ও উৎশৃঙ্খল জীবনযাত্রা জনগণের মনে প্রবল ক্ষোভের সঞ্চার করে। 

 ৪) ব্যর্থ পররাষ্ট্রনীতি :-

ফরাসি রাজন্যবর্গের দুর্বল আত্মঘাতী পররাষ্ট্রনীতি ফরাসি রাজতন্ত্রের মর্যাদাকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফরাসি সম্রাট পঞ্চদশ লুই অষ্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার সক্রান্ত যুদ্ধে ১৭৪০ - ১৭৪৮ এবং সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধে (১৭৫৬ - ১৭৬৩) অংশগ্রহণ করে। এর ফলে ইউরোপে ফ্রান্সের মর্যাদা বিনষ্ট হয়। ভারত ও আমেরিকার ফরাসি সাম্রাজ্য স্থাপনের আসা ধূলিসাৎ হয়। 

ফরাসি রাজকোষ শূণ্য হয়ে পড়ে। ষোড়শ লুই আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এর ফলে ফ্রান্সের অর্থসংকট তীব্র হয়ে ওঠে। তিনি স্টেট জেনারেল অধিবেশন আহ্বান করতে বাধ্য হন। যা ফরাসি বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করে। 

 ৫) দুর্বল অর্থনীতি :-

 ফ্রান্সের অর্থনীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থা ছিল বিশৃঙ্খল, অবৈজ্ঞানিক ও ত্রুটিপূর্ণ সরকারি আয় ব্যয়ের মধ্যে কোন সামঞ্জস্য ছিলনা। যাজক ও অভিজাত সম্প্রদায় দেশের মোট সম্পদের ৯৫℅ মালিক  হলেও তারা কোনো কর দিতেন না।

 অপরদিকে দেশের মাত্র ৫℅ সম্পদের  অধিকারী বিপুল সংখ্যাক সাধারণ মানুষ দেশের আদায়কৃত রাজস্বের ৯৫ ভাগ প্রদান করতেন। রাজকীয় করের পাশাপাশি ছিল সামন্তপ্রভুদের ও গির্জাকে প্রদত্ত নানা করের বোঝা ভ্রা ন্ত অর্থনীতি রাজপ্রাসাদের বিলাস বৈভব এবং বৈদেশিক যুদ্ধে অর্থব‍্যয় দেশের অর্থনীতিকে পতনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে দেয়। 

 ৬) ষোড়শ লুই এর দায়িত্ব :-

 জাতীয় সভা আহ্বানের পর তৃতীয় শ্রেণীর মুখপাত্র হিসেবে বুর্জোয়া শ্রেণী মাথাপিছু ভোটের অধিকার দাবি করেন। এবং অভিজাত শ্রেণীর বিশেষ সুবিধালোপের দাবি জানান। কোন কোন ঐতিহাসিক বলেন যে, যদি ষোড়শ লুই এইসকল দাবী বিরোধিতা না করতেন, যদি তিনি দেওয়ালে লিখন পড়ে দাবিগুলিকে দৃঢ় সমর্থন করতেন তবে বিপ্লব এড়ানো যেত।

কারণ বুর্জোয়া শ্রেণি অভিজাত শ্রেণীর শ্রেণির অধিকার গুলিকে আক্রমণ করে। রাজতন্ত্রকে তখনও তাদের আক্রমণের লক্ষ্য হিসেবে নেয়নি। ষোড়শ লুই তৃতীয় শ্রেণীর বিরোধিতা করায় তিনি তাদের আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত হয়। 

মাদেলাঁর মতে, এই সময় মিরাবুৎ রাজাকে অনেক বোঝাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনো ফল হয়নি।

 ৭ ) টেনিস কোর্টের শপথ :- 

ষোড়শ লুই এতে ভীত হয়ে আর একটি ভুল পন্থা অনুসরণ করলেন। তিনি তৃতীয় শ্রেণীর প্রতিনিধিদের সভাকক্ষে মিলিত হবার স্থান বন্ধ করে দিলেন। তাতে তারা ক্রুদ্ধ হয়ে নিকটবর্তী টেনিস কোর্টের সমবেত হয়ে শপথ গ্রহণ করলেন। এবং এক প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। 



এতে বলা হয়েছে যে, যতদিন ফ্রান্সের জন্য একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা হয় না হচ্ছে, ততদিন তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে চলবেন। রাজা ছাড়াই জনপ্রতিনিধিরা দেশের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রের কথা যে ভাবতে শুরু করেছিলেন এ থেকে তা বোঝা যায়। 

ফরাসি বিপ্লবে সামন্ততন্ত্রের বিলোপ :-

 ফরাসি বিপ্লবের মূল কারণ নিহিত ছিল সামাজিক বৈষম্যের মধ্যে। ফ্রান্সের মধ্যযুগীয় সামাজিক ব্যবস্থা 'বিশেষ অধিকারভোগী' এবং 'অধিকার বিহীন' এই দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। যাজক, অভিজাত ও অন‍্যান‍্য সম্প্রদায় নিয়ে মূল তিনটি এস্টেট বা শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল ফরাসি বাসিরা। সমাজের দ্বিতীয় শ্রেণীতে অভিজাতরা নানা ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক, ও অর্থনৈতিক বিশেষ অধিকার ভোগ করত অথচ তাদের কোনো কর দিতে হতো না।

অন‍্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিল অন্যায়, অত্যাচার ও শোষনের শিকার। তাদের প্রায় সব ধরনের করভার বহন করতে হতো। এর ফলে ১৭৯১ খ্রিষ্টাব্দের  সংবিধান সভার সব রকম সামন্ততান্ত্রিক অধিকার বিলুপ্ত ঘটায়। 

ফরাসি বিপ্লবের কারণ :-

 ফরাসি বিপ্লবের অনেকগুলো কারণ রয়েছে যেমন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ইত্যাদি কারণ পরিলক্ষিত হয়। এদের মধ্যে কয়েকটি কারণ সম্বন্ধে বিস্তারিত বর্ণনা করা হলো। 

সামাজিক কারণ :- 

 ১) বুর্জোয়া সম্প্রদায় :- 

 তৃতীয় শ্রেণীর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বুর্জোয়া ও মধ্যবিত্তরা। তারা ছিল বিপ্লবের অগ্রদূত। তাদের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণীবিভাগ ছিল। বড় ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও ব্যাংকারদের বলা হতো উচ্চ বুর্জোয়া। আর্থিক দিক থেকে সমৃদ্ধশালী হলেও এদের কোন সামাজিক মর্যাদা ছিল না।

আইনজীবী, চিকিৎসক, শিক্ষকরা ছিলেন মধ‍্য বুর্জোয়া। কারিগর, দোকানদার, কৃষক, শ্রমিক প্রভৃতিদের বলা হত নিম্ন বুর্জোয়া। সামগ্রিকভাবে বিদ‍্যা, বুদ্ধি ও ধনবলে অভিজাতদের চেয়ে বলবান হয়েও কেবল বংশ কৌলিন‍্যের অভাবে সমাজ ও রাষ্ট্র তারা আপ্রান্তেঁয় ছিল।

অভিজাত সম্প্রদায় তাদের ঘৃণার চোখে দেখত তারা ছিল চরমতম অসাম‍্যের শিকার ও কর ভারের নিপীড়িত। তাদের দাবি ছিল সামাজিক সম্মান, স্বীকৃতির মাপকাঠি হবে যোগ্যতা, বংশ কৌলিন্য নয়। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রতি তারা খুবই ঈষা পরায়ন ছিল। আর এই শ্রেণীগত ঈষায় বিপ্লবের প্রকৃত কারণ। 

 ২) অভিজাত সম্প্রদায় :- 

 সমাজের দ্বিতীয় শ্রেণীতে ছিল অভিজাত সম্প্রদায়। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে তাদের সংখ্যা ছিল ৩ লক্ষ ৫০ হাজার । দেশের সমগ্র জনসংখ্যা মোট দেশভাগের ১ ভাগ মাত্র। ফ্রান্সের কৃষিজমির পাঁচ ভাগের এক ভাগ ছিল তাদের অধিকারের।

 এইজন্য তারা সরকারকে কোন ভূমিকর দিত না। বরং তারা প্রজাদের কাছ থেকে নানা সামন্ত কর আদায় করত। তারা ছিল সমাজের সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী অংশ। সরকারি চাকরি, বিচার বিভাগের প্রশাসন যন্ত্র সব ছিল তাদের অধিকারে। তৃতীয় সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি তাদের ছিল তীব্র ঘৃণা ও অবজ্ঞা।

 ৩) যাজক সম্প্রদায় :-

 যাজকরা ছিল প্রথম সম্প্রদায়ভুক্ত। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে  তাদের সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ২০ হাজার। মোট জনসংখ্যা ১% না হয়েও সমাজ ও রাষ্ট্রে তারা প্রবল প্রতাপশালী ছিল। তারা ছিল আইনের ঊর্ধ্বে। তারা বিশেষ রাজনৈতিক ও বিচার বিভাগীয় অধিকার ভোগ করতো। শিক্ষা ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণাধীনে।

 যাজকদের অনেকে নিজস্ব প্রাসাদ-দুর্গ ও নিজেস্ব গির্জা ছিল বিপুল সম্পদ অধিকারী। এইসব যাজকেরা বিলাসব্যসন, আমোদ-প্রমোদ, ব‍্যাভিচারের সঙ্গে নিয়োজিত ছিল। 
প্রথম সম্প্রদায় যাজকেরা কিন্তু সমভাবাপন্ন ছিল না। তারা দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল।
 ক ) উচ্চতম যাজক। খ ) নিম্নতম যাজক। 

অর্থাৎ গ্রামীণ প্রাদীরা। গির্জার আয়ের সিংহভাগ ভোগ করত মুষ্টিমেয় উচ্চতর যাজকেরা। তারা বিলাস ব‍্যসন ও দুর্নীতিতে মগ্ন থাকত এবং নিম্নতম যাজকদের ঘৃনার চোখে দেখত। অপরদিকে গ্রামীন গির্জা সংখ্যাগুরু পাদ্রীদের অবস্থা ছিল শোচনীয়। তাদের বেতন ছিল খুবই কম। দারিদ্র ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী এর সত্ত্বেও ব্যক্তিগত জীবনের তারা ছিল নিষ্ঠাবান। উচ্চতম যাজকদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা ছিল।

অধ্যাপক সালভেমিনি বলেন যে, উচ্চতম ও নিম্নতম যাজকদের বিবাদ বিপ্লবের সাফল‍্যের অন‍্যতম কারণ।

 ৪) সুবিধাভোগী সম্প্রদায় :- 

দেশের শাসনভার ন‍্যস্ত ছিল রাজার সৃষ্ট একটি বিশেষ দলের হাতে। আর যারা অভিজাত হয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাদের শাসনকার্যে কোন ক্ষমতা না থাকলেও তারা কয়েকটি সুবিধা ভোগ করতো, যেমন- কর দিতে হতো না

 সৈন্যবাহিনীতে অফিসার তাদের মধ্যে থেকেই নিযুক্ত হতো এবং বিচারালয়ের বিচারক তাদের মধ্যে থেকেই নেওয়া হতো।এর উপর ভিত্তি করেই প্রাচীন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু তৎকালীন ফ্রান্সের সামাজিক ব্যবস্থা একটু পরীক্ষা করেলেই বোঝা যাবে যে বাস্তব অবস্থা থেকে এটা কতদূর ছিল।

 ৫) সামাজিক অসাম্য :- 

ফরাসি সমাজ পাঁচ ভাগে বিভক্ত ছিল - অভিজাত শ্রেণী, উচ্চপদস্থ, রাজকর্মচারী, যাজক, মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবং কৃষক সম্প্রদায়। প্রকৃতপক্ষে ফরাসি সমাজ কিন্তু এত সহজ-সরল ছিল না। বিশেষ জটিল আকার ধারণ করেছিল।সমাজের প্রত‍্যেক শ্রেণীর মধ্যেই শ্রেণি সংঘাত দেখা দেয়। ফলে প্রত‍্যেক শ্রেণি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যাজকরা সবাই সমান ছিল না সুতরাং ফরাসি সমাজের অসাম‍্যের অন্ত ছিল না। 

 ৬) কৃষক সম্প্রদায় :-

 তৃতীয় শ্রেণীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল কৃষকরা। মোট জনসংখ্যার শতকরা ৮০ ভাগ ছিল কৃষকরা। এদের আর্থিক অবস্থা ছিল শোচনীয়। এবং তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের নানাভাবে নিপীড়িত হত। 
তাদের মধ্যে নানা শ্রেণীবিভাগ ছিল - স্বাধীন কৃষক, ভাগচাষী, খাজনা চাষী, ক্ষেত মজুর এবং সবার নিচে ছিল অসংখ্যক ভূমিদান,

মার্কসবাদী ঐতিহাসিকদের লাবুশ এর মতে, " অষ্টাদশ শতকে ফরাসি কৃষকরা ছিল সর্বাপেক্ষা শোষিত"। রাষ্ট্র সামন্ত প্রভু ও গির্জাকে তারা নানা ধরনের কর দিতে বাধ্য ছিল। সামন্ত প্রভুদের নানা ধরনের কর দিতে বাধ্য হতো। গির্জা তাদের কাছ থেকে 'তাইদ' বা ধর্মকর আদায় ছিল আদায় করত। বিপ্লব শুরু হলে করভারের জড়র্জড়িত কৃষকেরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করে।

 ৭) অন্যান্য সম্প্রদায় :- 

তৃতীয় সম্প্রদায়ে অন্যান্যদের মধ্যে শ্রমিকেরা শহরের কল কারখানার কাজে নিযুক্ত ছিল কিন্তু স্বল্প মজুরি, চাকরি নিরাপত্তাহীনতা বা বছরের অনেক সময় বেকার হয়ে বসে থাকার কারণে তাদের জীবন ছিল অন্তত করুন। 

এছাড়াও কারিগর, ব্যবসায়ী এবং চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, আইনজীবী ইত্যাদি বিদ‍্যা বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে আর্থিক স্বচ্ছলতা আনলেও সমাজে প্রাপ‍্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত ছিল। 

 অর্থনৈতিক কারণ:- 

 ১) আর্থিক দুরবস্থা :-

 ফ্রান্সের অর্থনৈতিক দুরবস্থা বিপ্লব আনতে সাহায্য করেছিল। ফ্রান্সের সকল সুবিধা ধ্বনি অভিজাত ও যাজক সম্প্রদায় ভোগ করত। তাদের কোনো রকম কর দিতে হতো না। সামন্ততন্তের নীতি অনুসারে কৃষকরা বেকার খেটে মরত। 

আর অভিজাতরা নিশ্চিত বিলাসে দিন যাপন করত। দেশের ভালো ভালো জমি তাদের দখলে ছিল। রাষ্ট্রের ভালো ভালো চাকরি তারাই পেতো। রাষ্ট্রের সমগ্র আয়ের প্রায় সমস্তটাই সাধারণ প্রজাদের কাছ থেকে নেওয়া হতো।

 ২) করব্যবস্থা :-

করধার্য সম্পর্কে কোন ন্যায় সঙ্গত নীতি ছিল না। ফ্রান্সে প্রধানত তিনটি প্রত‍্যক্ষ কর জনসাধারণের উপর ধার্য করা হতো। যথা - " টেইলি", "ক‍্যাপিটেশন", এবং "ভিংটিয়েমে" । এই কর গুলি কখন কিসের উপর ধার্য হবে তা করদাতারা জানতেন।

তাছাড়া পরোক্ষ করের সংখ্যাছিল অগণ্য। ফ্রান্সের এক এক অঞ্চলে লবনের জন্য এক এক রকম দাম আদায় করা হতো। 'টেইলি' কর কখনো জমির উপর ধার্য হতো, কখনো আয়ের বিভিন্ন উৎসের উপর ধার্য হত। এরূপ অবস্থায় কোনো ন্যায়বিচার ছিল না। 

 ৩) গিল্ড ব্যবস্থা :-

 ব্যবসায়ীদের দৃষ্টিভঙ্গিও সংকীর্ণ ছিল। গিল্ড দেশের শিল্প নিয়ন্ত্রণ করত এবং বিভিন্ন গিল্ড গুলি ছিলো সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীনে। শিক্ষানবীশ কর্মীদের স্বাধীন কারিগর হবার কোনো সুযোগ ছিল না। হাড়ভাঙ্গা খাটুনি অল্প মজুরি তাদের জীবনকে দুষ্কর করে তুলেছিল।

কারিগরদের অবস্থাও ভাল ছিল না। কিন্তু শিল্প মালিক ও ব্যবসায়ীদের অবস্থা খুবই ভালো ছিল। তবে অন্তরীণ করভার, প্রাদেশিক শুল্ক, রাজপথ, নদীপথ, নগর শুল্ক ইত্যাদি ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে বাধার সৃষ্টি করেছিল। এই কারণে ব্যবসায়ীরা সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায়। 

রাজনৈতিক কারণ :- 

 ১) বুরবোঁ রাজতন্ত্র :

- ফরাসি বিপ্লব ছিল প্রকৃতপক্ষে দীর্ঘদিন ধরে বুরবোঁ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে জমে থাকা রাগের বহিঃপ্রকাশ। রাজারা ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতায় বিশ্বাসী ছিলেন ও তারা বংশানুক্রমিকভাবেই তাদের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন।

 ২) রাজাদের দূবর্ল শাসন :- 

রাজা চতুর্দশ লুই ১৬৪৩ - ১৭১৫ খ্রিষ্টাব্দের  বিলাস-ব্যসনে নিমজ্জিত থেকে স্বৈরাচারী ক্ষমতার মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। 

কিন্তু পরবর্তীতে রাজা পঞ্চদশ লুই ১৭১৫-১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ছিলেন বিলাসী, অলস, ও পরিশ্রম বিমূখ। ফরাসি বিপ্লবের ক্ষেত্রে আরও বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণ ছিল যেমন - 

 ৩) নারীদের অবস্থান :- 

ফরাসি বিপ্লবে নারীদের মর্যাদা ছিল খুবই ক্ষীণ। নারীদের ওপর প্রচুর নির্যাতন করা হতো।
 
১ ) নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের পূর্ণগঠন যা রাজতন্ত্রের পক্ষে ছিল বেশ ক্ষতিকারক
২ ) স্বাধীনতা ও প্রজাতান্ত্রিক আদর্শের অনুপ্রেরণা ইত্যাদি। 

 উপসংহার :- 

আধুনিক ঐতিহাসিকরা ফরাসি বিপ্লবের প্রধান কারণ অর্থনৈতিক বলে মনে করেন না। তারা অবশ্য স্বীকার করেন যে, বিপ্লবের আগে ফ্রান্সের অর্থনৈতিক সংকট তীব্রতর হয়। এই সংকটই অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় গোটা দেশে গণ বিক্ষোপ দেখা দেয়, যা বিপ্লবের সূচনা হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। 

কিছু ঐতিহাসিক অবশ‍্য অর্থনৈতিক সংকটের চেয়ে রাজনৈতিক বা সামাজিক সংকটকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। 

সুতরাং, উপরিক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে ফরাসি বিপ্লব বিশ্বের ইতিহাসের ভীত নারিয়ে দিয়েছিল। এবং এর ফলে সামন্ত তন্ত্রের বিলুপ্ত ঘটেছিল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ