শিল্প বিপ্লব (The Industrial Revolution)
ইউরোপে তথা সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে শিল্প বিপ্লব ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী একটি অধ্যায়। প্রথম ১৮৩৭ সালে অগাস্ত ব্ল্যাংকি শিল্প বিপ্লব ব্যবহার করেছিল। ইংল্যান্ডে সর্বপ্রথম শিল্প বিপ্লব ঘটেছিল। শিল্প বিপ্লবের ফলে কৃষি ও বাণিজ্যিক ব্যবস্থা থেকে আধুনিক শিল্পায়নের দিকে এগোতে শুরু হওয়ার অর্থনৈতিক অবস্থার একটি বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটেছিল।
INDEX :
- ভূমিকা
- শিল্প বিপ্লব
- শিল্প বিপ্লবের সংজ্ঞা
- ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব
- ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্প বিপ্লব ঘটার কারণ
- শিল্প বিপ্লবের কারন
- ইউরোপে শিল্প বিপ্লব আশীর্বাদ না অভিশাপ
- শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণ
- আইন প্রণয়ন
- শিল্প বিপ্লবের ফলাফল বা প্রভাব
- উপসংহার
ভূমিকা :-
ইউরোপে তথা সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে শিল্প বিপ্লব ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী একটি অধ্যায়। প্রথম ১৮৩৭ সালে ফরাসি সমাজবিদ ও দার্শনিক অগাস্ত ব্ল্যাংকি (Louis-Auguste Blanqui) শিল্প বিপ্লব ব্যবহার করেছিল।
পরবর্তীতে জন স্টুয়ার্ট মিল ও কাল মার্কস এই শিল্প বিপ্লব কথাটি প্রয়োগ করেন। এবং ইংল্যান্ডে সর্বপ্রথম শিল্প বিপ্লব ঘটেছিল।
এই সময় ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের ফলে কৃষি ও বাণিজ্যিক ব্যবস্থা থেকে আধুনিক শিল্পায়নের দিকে এগোতে শুরু হওয়ার অর্থনৈতিক অবস্থার একটি বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটেছিল।
শিল্প বিপ্লব :-
শিল্প বিপ্লব বলতে সাধারণত যন্ত্রের সাহায্যে অল্প শ্রমে কম সময়ে বেশি উৎপাদনের পদ্ধতি। কুটির শিল্পকে কেন্দ্র করে যন্ত্র উৎপাদনের আগে পণ্য উৎপাদিত হতো।
পরিবারের লোকেরাই এতে অংশগ্রহণ করতেন। যেমন, তাঁত শিল্পের পরিবারের কোনো ব্যক্তি হয়তো তাঁত বুনতো, কেউ সুতো কাঁটতো, কেউবা সুতোয় রং দিত, কেউবা নকসা তুলত, কেউ কাপড় বুনতো এইভাবে বিভিন্ন কাজে পরিবারের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ও বাড়ির মহিলারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে উৎপাদনে সাহায্য করতেন। এবং এর বাজার ছিল সীমিত। আশেপাশে হাটে-বাজারে তা বিক্রি করা হতো।
এই রকম উৎপাদনের প্রধান অবলম্বন ছিল মানুষের শ্রম। সাবেকি অনুন্নত যন্ত্রপাতি দিয়ে পণ্য উৎপাদন উৎপাদন করা হতো। দূর অঞ্চলে পরিবহন ব্যবস্থা ছিল না বলে আঞ্চলিক বাজারেই তা বেচা-কেনা হতো। এবং সেখানেই তা সীমাবদ্ধ ছিল। ক্রুস্চেভ ভৌগলিক আবিষ্কার ইত্যাদির ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। আস্তে আস্তে পণ্যের চাহিদাও বৃদ্ধি পেতে আরম্ভ করে।
বাণিজ্যের স্বার্থে বণিকেরা নিজেরাই কুটির শিল্পের কারিগর এর কাছ থেকে পণ্য কিনে নিত। এবং আগ্রিম দাদন দিত। এর ফলে উৎপাদন ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। কাঁচামালের চাহিদা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। অধিক উৎপাদনের তাগিদ কুটির শিল্পের মালিকরা অর্থের বিনিময়ে পরিবারের বাইরে থেকে কিছু লোক নিয়োগ করতে আরম্ভ করল।
ক্রমে পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ার পণ্যের চাহিদাও বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। বেশি মুনাফার তাগিদে মজুরীভোগী শ্রমজীবীদের ওপর কাজের চাপ যেমন বেড়ে যায় ঠিক তেমনি এক জায়গায় প্রচলিত যন্ত্রপাতির সাহায্যে শ্রমিক নিয়োগ করে উৎপাদনের পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়।
এইভাবে কারখানার আবিষ্কার ঘটে। কাজের চাপে ক্লিস্ট শ্রমিকরা শ্রম লাভের জন্য নানাভাবে চেষ্টা করতে থাকে। এদের চেষ্টার ফলে বিশ্বের ইতিহাসে নতুন নতুন উন্নত মানের যন্ত্রপাতির আবিষ্কার হয়। এই সকল যন্ত্রপাতির দ্বারা অল্প সময়ে কম শ্রমে বেশি পণ্য উৎপাদিত করা যেত, উৎপাদন পদ্ধতির এই যে পরিবর্তন এই পরিবর্তনকে সাধারণভাবে আমরা শিল্প বিপ্লব বলে থাকি।
শিল্প বিপ্লবের সংজ্ঞা :-
এক কথায় আমরা বলতে পারি অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময় কালে প্রথমে ইংল্যান্ডে পরে ইউরোপের অন্যান্য দেশে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি বা আধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতিকে কাজে লাগিয়ে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যে অদ্ভুতপূর্ব পরিবর্তন ও উন্নয়ন পরিলক্ষিত হয় তাকেই "শিল্প বিপ্লব" বা "Industrial Revolution" বলা হয়।
শিল্প বিপ্লব বা Industrial Revolution হলো ১৭০০শতকের শেষের দিকে এবং ১৮০০ শতকের প্রথম দিকে ঘটে যাওয়া বড় ধরনের শিল্পায়নের একটি যুগসন্ধিক্ষণ। ইংল্যান্ডের এই শিল্প বিপ্লব শুরু হয় এবং দ্রুত গতিতে সারাবিশ্বের এই শিল্প বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ে।
আমেরিকার শিল্প বিপ্লব হল দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব। এই সময় কৃষি, পোশাক শিল্পে যান্ত্রিকরণ; একটি শক্তি বিপ্লবসহ বাষ্প চালিত জাহাজ, রেল পথ এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইত্যাদির পরিবর্তন ঘটায়।
আবার বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও অর্থনীতিবিদ শিল্প বিপ্লবের বিভিন্ন সংজ্ঞা নিরূপণ করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো-
১) ফিলিস ডিন :-
এর সংজ্ঞা আর্থিক ব্যবস্থার পরিবর্তন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার ও শিল্প সংগঠনের মাধ্যমে উৎপাদন ব্যবস্থায় যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে তাই শিল্প বিপ্লব। অর্থাৎ তিনি এ প্রসঙ্গে তিনটি দিকের পরিবর্তনের উল্লেখ করেছেন। যথা, অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত এবং পদ্ধতি ও মনোগত।
২) ফিসার :-
এর মতে দৈহিক শ্রমের পরিবর্তে যন্ত্রের দ্বারা শিল্প সামগ্রীর উৎপাদনকেই শিল্প বিপ্লব বলে।
৩) হার্টওয়েল :-
এর মতে মানুষ যখন প্রাকৃতিক সম্পদকে আগের থেকে অনেক বেশী দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করে মাথাপিছু উৎপাদন বাড়ায় তখন তা হল শিল্প বিপ্লবের নিদর্শন।
৪) সিপোলা :-
এর ভাষায় সংকীর্ণ প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে শিল্পবিপ্লবকে একটি প্রক্রিয়া রূপে বর্ণনা করা যেতে পারে। যেখানে সমাজ প্রচুর জড় শক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ করে।
ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব :-
শিল্প বিপ্লবের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Industrial Revolution এই শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন ইংরেজি ঐতিহাসিক এরনল্ড টয়েনবী (Arnold Toynbee)।
১৮৮০ সালে তাঁর লেখা "lectures on the Industrial Revolution in England" গ্রন্থে এটা ব্যবহার করেন।
ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার বহু কারণের মধ্যে সর্বাপেক্ষা একটি বড় কারণ ছিল পুঁজির জোগান।
ঔপনিবেশিক ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে অধিক পুঁজির জোগান এসেছিল এই সংস্থা থেকে। ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হবার কারণে দুটি সমস্যা লক্ষ্য করা যায়। একটি হলো কাঁচামালের অভাবে এবং দ্বিতীয়টি হলো উদ্বৃত্ত দ্রব্য সামগ্রী বিক্রয়ের জন্য বাজার।
এই দুটি সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় হল উপনিবেশ স্থাপন। খনিজ ও বাণিজ্যিক কৃষিতে সমৃদ্ধ উপনিবেশ থেকে একদিকে যেমন কাঁচামাল সংগ্রহ করা যাবে, তেমনি অপর দিকে সেখানেই উদ্বৃত্ত দ্রব্য সামগ্রীর বিক্রয়েরও সুযোগ থাকবে। তবে একাজ খুব একটা সহজ সাধ্য ছিল না।
উপনিবেশ গুলির পক্ষে এই সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা অসম্ভব ছিল। এর ফলে ইংল্যান্ড আমেরিকায় তার এই নীতি অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়।
১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল আমেরিকা। কিন্তু ভারত সহ এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ইংরেজরা ক্ষমতায় তাদের উপনিবেশ ও সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হয়েছিল।
উপনিবেশবাদ বলতে বোঝায় সাধারণত এমন এক ব্যবস্থা যাতে মাতৃভূমির স্বার্থে বাহুবলে অধিকৃত এশিয়া ও আফ্রিকার দেশ গুলিকে শোষণ করে। উপনিবেশিক অর্থনীতিতে স্থানীয় শিল্পের যেনো কোনো রকম বিকাশ না ঘটে। অথবা উন্নত হস্ত বা কুটির শিল্প যেখানে রয়েছে, তার যাতে পতন বা ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে সেদিকে লক্ষ্য রাখা হয়।
সুতরাং উপনিবেশগুলি স্বাধীনভাবে অর্থনীতি নির্ধারণ করবার সুযোগ ও স্বাধীনতা থাকে না।
ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্প বিপ্লব ঘটার কারণ :
শিল্প বিপ্লবের তিনটি জিনিসের প্রয়োজন ছিল ---- কাঁচামাল, প্রতিদ্বন্দ্বীহীন বিস্তৃত বাজার এবং মূলধন। ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব প্রথম দেখা দেয় কারণ ইংল্যান্ডে এই তিনটির মধ্যে কোনটিরও অভাব হয়নি। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের অধীনে উপনিবেশ ছিল। সমৃদ্ধশালি ভারতবর্ষই তার কুক্ষিগত ছিল।
অতএব এই সকল দেশ থেকে ইংল্যান্ড প্রচুর পরিমাণে কাঁচামাল পেত। আবার এই সকল দেশে তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। তার উৎপাদিত জিনিসগুলি এই সকল দেশে প্রচুর পরিমাণে বিক্রয় হতে লাগল।
এছাড়া ইংল্যান্ডের মূলধনেরও অভাব হয়নি। ভারতে যুগ যুগ ধরে যে অর্থ-সম্পদ সঞ্চিত ছিল তা ইংল্যান্ডের শোষনের ফলে ভারতবর্ষ থেকে ইংল্যান্ডে চলে যেতে লাগল। এই অর্থ মূলধন হিসেবে ব্যবহার করে ইংল্যান্ড শিল্প বিপ্লবের পথে অগ্রণী ভূমিকা নেয়। তার সাম্রাজ্য ছিল পৃথিবীজুড়ে বা বিশ্বজুড়ে।
কথাই ছিল, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কখনো সূর্য অস্ত যায় না। ইংল্যান্ডের পড়েই ছিল ফ্রান্সের স্থান। ফ্রান্সে শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল বেশ কিছুটা দেরিতে।
আরো অনেক পরে জার্মানি, রাশিয়া, ইতালিতে শিল্পবিপ্লব ঘটেছিল বলে এরা উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় তারা বেশ অনেকটা পিছিয়ে ছিল।
যাইহোক, উনিশ শতকের শেষ পর্বে আফ্রিকা প্রায় সর্বত্র এবং এশিয়ার এক বৃহৎ অংশ জুড়ে উপনিবেশ স্থাপন হয়েছিল।
◆ ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্প বিপ্লব ঘটার আরো বেশ কিছু কারণ ছিল।
এগুলো হলো:
১) সুলভ শ্রমিক :-
অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডে জনসংখ্যা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় ইংল্যান্ডের কারখানাগুলোতে প্রচুর সংখ্যায় সুলভ শ্রমিকের যথেষ্ট অভাব ছিল।
২) সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা :-
দেশে শিল্পের প্রসারে ব্রিটিশ সরকার শ্রমিক ও শিল্পপতিদের নানাভাবে সাহায্য করত। কিন্তু অন্যান্য দেশের বণিক ও শিল্পপতিরা পুরোটা নিজের উদ্যোগে শিল্পের প্রতিষ্ঠা করত।
৩) প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ :-
ইংল্যান্ডের প্রাকৃতিক সম্পদ যথেষ্ট পরিমাণে উন্নত ছিল অন্যান্য দেশের তুলনায়।
শিল্প বিপ্লবের কারন :-
বিজ্ঞানের অগ্রগতি তথা বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের উত্তরণ :-
১) বস্ত্র শিল্পে যন্ত্রপাতির আবিষ্কার ও প্রয়োগ :-
বস্ত্রশিল্পে যন্ত্রপাতির উদ্ভাবনের মধ্যে দিয়ে অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয়। ১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দে জন কে নামক এক ' ফ্লাই শাট্ল' অর্থাৎ দ্রুতগতিতে চালানো যায় এমন মাকু আবিষ্কার করেন।
১৭৬৪ খিষ্টাব্দে জেমস হারগ্রীভস 'স্পীনিং জেনি (Spinning jenny) ' নামক একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন। তার ফলে আটগাছা সুতা একসঙ্গে কাটা যেত। ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে আর্করাইট ' ওয়াটার ফ্রেম (water frame) ' নামক জলচালিত শক্তির সাহায্যে যন্ত্র চালাবার কৌশল উদ্ভাবন করেন।
'ওয়াটার ফ্রেম' প্রকৃতপক্ষে কারখানা প্রথার ভিত্তি স্থাপন করে। ১৭৭৯ খ্রিষ্টাব্দে কার্টারাইট 'পাওয়ার লুম (Power loom)' নামক শক্তিচালিত তাঁত আবিষ্কার করেন।
এই সকল যন্ত্র আবিষ্কারের ফলে বস্ত্র বয়ন শিল্পে যুগান্তর দেখা দেয়। অল্পশ্রমে, অল্পমূল্যে প্রচুর পরিমাণ যন্ত্র উৎপাদিত হতে থাকে এবং বিশ্বের বাজারে ইংল্যান্ডের উৎপাদিত চাহিদা অভাবনীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়।
২ ) যন্ত্র বাষ্পীয় শক্তির প্রয়োগ :-
বাষ্পশক্তি আবিষ্কার না হলে শিল্প বিপ্লব বেশিদুর অগ্রসর হতে পারতো কিনা তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বাষ্পশক্তি সম্বন্ধে ধারণা আগে থেকে ছিল।
কিন্তু তাকে উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত করার কৌশল অজানা ছিল।
১৭৬৯ খিস্টাব্দে জেমস্ ওয়াট সর্বপ্রথম বাষ্পচালিত ইঞ্জিন আবিষ্কার করেন।
তার অন্যতম কৃতিত্ব হল বাষ্পশক্তির সাহায্যে যন্ত্র চালাবার কৌশল আবিষ্কার। জর্জ স্টিফেনসন্ সর্বপ্রথম রেলইঞ্জিন আবিষ্কার করেন।এর ফলে পরিবহন ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে।
৩) পরিবহন ব্যবস্থা :-
শিল্প বিপ্লবের পূর্ববর্তী সময়ে রাস্তাঘাটের অবস্থা ছিল শোচনীয়। ফলে কারখানায় উৎপাদিত দ্রব্যাদি বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ ছিল দুরূহ। এর জন্য উত্তম পরিবহন ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল। টেলিফোর্ড ও ম্যাক অ্যাডাম নামক দুজন ইঞ্জিনিয়ার পাকা রাস্তা নির্মাণের নতুন উপায় উদ্ভাবন করেন। এসময় জলপথের সুবিধায় মালপত্র প্রেরণের জন্য ইঞ্জিনিয়ার জেমস ব্রিন্তলি চমৎকার খাল খননের এক নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন করেন।
৪) লৌহ ইস্পাত শিল্পের ক্ষেত্রে নতুন কলাকৌশলের প্রয়োগ :-
নতুন নতুন কলকারখানা ও যন্ত্রপাতি নির্মাণের জন্য প্রচুর পরিমাণে ইস্পাতের প্রয়োজন দেখা দেয়। পূর্বে আকরিক লোহা গলাবার জন্য প্রচুর জ্বালানি কাঠের ব্যবহার হতো। তা ছিল শ্রমসাপেক্ষ ও অর্থনৈতিক দিক থেকে ক্ষতিকারক। এই কারণে একমাত্র যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণের ক্ষেত্রেই ইস্পাতের ব্যবহার হতো। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে জন স্নীটন লৌহ গলাবার একপ্রকার নতুন চুল্লি আবিষ্কার করলেন লৌহ ও ইস্পাত শিল্পের ক্ষেত্রে এক বিরাট পরিবর্তন আসে। কয়লা ও লৌহ - আকরিক খনিগর্ভ থেকে উত্তোলনের জন্য নানা প্রকার যন্ত্র ব্যবহৃত হতে থাকে। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে 'হ্যামফ্রে ডেভি' র আবিষ্কৃত 'নিরাপদ বাতি' কয়লাখনির কাজকে সহজ ও নিরাপদ করে তোলে। তারপর বৈদ্যুতিক শক্তি আবিষ্কৃত হয়। বৈদ্যুতিক শক্তির প্রয়োগ উৎপাদন প্রণালীকে অধিকতর দ্রুত করে তোলে।
৫) কৃষি ক্ষেত্রে পরিবর্তন :-
ইংল্যান্ডের সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক উপায়ে কৃষির উন্নয়ন ঘটে। একই জমিতে বিভিন্ন শস্য উৎপাদনের প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা হলে কৃষির ক্ষেত্রে এক বিরাট বিপ্লব আসে। পতিত জমি উদ্ধার করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষেত খামারকে বৃহদাকার ক্ষেত খামারে পরিণত করা হয়। এবং পার্লামেন্টের আইনের ধারা বহু উন্মুক্ত জমি ও সাধারণ গোচারণ ভূমিতে ব্যাপকভাবে চাষা-আবাদ শুরু হয়। প্রচুর মূলধন বিনিয়োগ করে জমির উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধি করা হয়। কৃষিক্ষেত্রে পরিবর্তনের ফলে ক্ষুদ্র চাষী ও পশুপালকগন তাদের জীবিকা থেকে বঞ্চিত হয়। তাদের অধিকাংশই শিল্প-শ্রমিকে পরিনত হয়। যন্ত্র শিল্পের প্রসারের ফলে জীবিকাচ্যুত বহু মানুষ গ্রাম থেকে শিল্পের কেন্দ্র শহরগুলিতে চলে আসতে থাকে। ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব হয়েছিল।
ইউরোপে শিল্প বিপ্লব আশীর্বাদ না অভিশাপ :-
আঠারো শতকের প্রথম দিকে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে, পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। প্রাচীন গ্রামকেন্দ্রিক কৃষি ব্যবস্থা ভেঙ্গে চুরে শহরকেন্দ্রিক কলকারখানা গড়ে উঠেছে। পুরো ইউরোপে উন্নয়নের শীর্ষে এগিয়ে আছে গ্রেট ব্রিটেন। আধুনিক শিল্পভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য অর্থ সামাজিক এক পরিবর্তন হচ্ছে। ইউরোপে ঘটে যাওয়া এই পরিবর্তন হচ্ছে শিল্প বিপ্লব বা Industrial Revolution। ইউরোপে শিল্প বিপ্লব সাধারণত কোন একদিনের ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়।পুরো মহাদেশেই এক অদ্ভুতপূর্ব ক্রমান্বয়ে শিল্পভিত্তিক পরিবর্তন ঘটেছিল। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপে বেড়ে চলা জনসংখ্যা এই পরিবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা থেকে দলে দলে দক্ষ, কর্মঠ শ্রমিক শ্রেণী তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে উৎপাদন ক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব হয়েছে এবং সেগুলো ব্যবহার এই উন্নয়নের পরিবর্তনকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলেছিল। জনসংখ্যার চাহিদা মেটানোর জন্য এ সময়ে পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। উন্নয়ন বিপ্লবের এই প্রতিযোগিতার ব্রিটেন দুটি কারণে ইউরোপের অধিকাংশ দেশ থেকে বেশ খানিকটা এগিয়ে ছিল।
১) উৎপাদনমুখী এবং স্বনির্ভর কৃষি ব্যবস্থা।
২) বিস্ময়কর এক ' উদ্ভাবক ' শ্রেণি।
এই দুই সুনির্দিষ্ট কারণে ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলের থেকে ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লবের সাফল্য অগ্রগতি সবচেয়ে দ্রুত কার্যকরী ছিল।
গ্রেট ব্রিটেন :- ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের অঞ্চলগুলোতে সর্বপ্রথম 'সুতো কাটার যন্ত্র' তৈরি হলে বস্ত্রশিল্পে এক অপার সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি হয়। পরবর্তীকালে তাঁত বুনন যন্ত্র আবিষ্কার হলে প্রচলিত বুনন পদ্ধতির পরিবর্তে যান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হয়। এবং ফলাফল হিসেবে বস্ত্র শিল্পে এক বিরাট আমুল পরিবর্তনের জোয়ার সৃষ্টি হয়।
তাছাড়া লৌহ শিল্প, কয়লা থেকে ইঞ্জিন চালানোর কৌশল ইত্যাদিতে বিরাট পরিবর্তন ঘটে। এই সময় ব্রিটেনের চারপাশে শুধুই পরিবর্তনের জোয়ার, কারখানায় লোহার ঝনঝনানি, ব্রিটেনের সেইসময় কয়লাভিত্তিক ইঞ্জিনের কালো ধোঁয়া আকাশে বাতাসে। গ্রামের থেকে বহু মানুষ নতুন শিল্পায়নের কাজের খোঁজে দলে দলে আসতে শুরু করে। এর ফলে গ্রামের চেহারার বিরাট পরিবর্তন ঘটে গ্রামগুলি ক্রমশ শিল্পভিত্তিক শহরে পরিণত হতে থাকে। শ্রমিকেরা ব্যস্ততার যান্ত্রিক জীবনে জড়িয়ে শহরের স্যাঁতস্যাঁতে বস্তি এলাকায় বসবাস করতে আরম্ভ করে। মহিলা ও পুরুষ উভয়েই কয়লা খনি ও টেক্সাইল শিল্পে ১৪ ঘণ্টা অমানুষিক পরিশ্রম করতে কিন্তু পরিবর্তে মহিলারা পুরুষের তুলনায় অনেক কম মজুরি পেত। আস্তে আস্তে সস্তায় শিশুশ্রমের বিষয়টিও খুব বেড়ে যায়, এবং কাজ খুব তাড়াতাড়ি পাওয়ার জন্য শ্রমিকদের মধ্যে সবসময় একটা কাজ হারানো, না খেয়ে দিন কাটানোর ভয় কাজ করত। শ্রমিক নির্যাতন, হতাশা, ন্যায্য পরিশ্রমিক না পাওয়ার মতো বিষয়গুলো থেকে ক্রমান্বয়ে শ্রমিক অসন্তোষের রূপ নিতে শুরু করে। এর ফলে বেশ কয়েকটি কারখানায় শ্রমিক বিদ্রোহ ঘটে। রেল লাইন, যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতি ইত্যাদির মাধ্যমে পরিবহন ব্যবস্থার বদৌলতে শিল্প - কারখানা এবং পণ্যের উৎপাদন আগুনের মতো পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল।
ফ্রান্স :- ব্রিটেনর বাইরে ইউরোপের অন্যান্য দেশের মধ্যে একমাত্র ফ্রান্সেই সমসাময়িক সময়ে ব্রিটেনের সমান তালে শিল্প বিপ্লব ঘটেছিল। ব্রিটেনের মতো ফ্রান্সেও আঠারো শতকের প্রথম ভাগে সুতোর উৎপাদন রাতারাতি পাঁচ গুণ বেড়ে গিয়েছিল। ব্রিটেনের মতো কয়লা ও লোহার মজুরি না থাকায় ফ্রান্সে এই ধরনের শিল্পগুলিতে খানিকটা দেরিতে হলেও সেখানে বিরাট এক বড়ো রকমের কোনো পরিবর্তন ঘটে। ঊনিশ শতকের মাঝের দিকে ফ্রান্সের রেল ব্যবস্থায় বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়। এবং ধীরে ধীরে কৃষিনির্ভর ফ্রান্স শিল্পনির্ভর ফ্রান্সে রূপান্তরিত হতে শুরু করে।
জার্মানি :- রাজনৈতিক কারণে জার্মানিতে শিল্পভিত্তিক অগ্রগতি খানিকটা পরে দৃশ্যমান হয়। ১৮৩৪ সালের পরে জার্মানির খনি অঞ্চলগুলিতে কলকারখানার বিস্তার ঘটে ও এইসময়ে রেল ব্যবস্থার সম্প্রসারণের ফলে স্টিল ও যান্ত্রিক প্রকৌশল ব্যবস্থায় বেশ বড় রকমের একটা পরিবর্তন সাধিত হয়। পর্যাপ্ত পুঁজি ও দক্ষ জনবলের কারণে জার্মানিতে ১৯ শতকের শেষের দিকে শিল্পভিত্তিক পরিবর্তন বেশ দেরিতে হলেও রসায়ন ও বৈদ্যুতিক প্রযুক্তির পরিবর্তন ঘটে এবং ইউরোপের অন্যান্য সব দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিল্পনির্ভর জার্মানির উত্থান ঘটে।
শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণ :-
গোটা ইউরোপ জুড়ে বেশ কয়েকটি বড় রকমের শ্রমিক দাঙ্গা পরবর্তীকালে সংঘটিত হতে থাকে। ও শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণে ইউরোপের দেশে দেশে " ট্রেড ইউনিয়ন " প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বেতন সুবিধা ভোগী ও কাজের পরিবেশের দাবিতে পরবর্তীতে ইউরোপের বিভিন্ন অংশে শ্রমিক বিক্ষোভ ঘটে। উত্তাল আন্দোলনের মূখে বিভিন্ন দেশে প্রথম ১২ ঘণ্টা এবং পরে ১০ ঘণ্টা করে কর্ম দিবস চালু করে।
আইন প্রণয়ন :-
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কিছু আইন প্রণয়নের প্রবর্তিত হয়। যেমন, শিশুশ্রম বন্ধ, অসুস্থতা, দুর্ঘটনা, বয়স কালীন নিরাপত্তা জন্য ভাতা ব্যবস্থা ইত্যাদি চালু হলে পুরো ইউরোপের শ্রমিক ইত্যাদি চালু হলে পুরো ইউরোপে শ্রমিক কল্যাণে এক যুগান্তকারী অদ্ভুতপূর্ব পরিবর্তন ঘটে।
শিল্পায়নের কারণে ইউরোপের একদিকে গ্রাম উজাড় করে কলকারখানা প্রতিষ্ঠার ফলে শহরায় হয়েছে। ঠিক তেমনি শহরকেন্দ্রিক আবাসনের নামে বস্তির সংখ্যা বেড়েছে। অর্থাৎ শিল্পবিপ্লব যেমন আধুনিক পণ্য, পরিবহন ও যোগাযোগ ইত্যাদি ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছে ঠিক তেমনি ভাবেই শান্ত নির্জন এবং কৃষিভিত্তিক ইউরোপকে কেড়ে নিয়েছে। অতএব বলা হয় ইউরোপের শিল্প বিপ্লব একদিক থেকে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে অপরদিকে অভিশাপ।
শিল্প বিপ্লবের ফলাফল বা প্রভাব :-
ইউরোপে তথা বিশ্বের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে শিল্প বিপ্লবের প্রভাব বা ফলাফল লক্ষ্য করা যায়। যথা-----
আর্থ - সামাজিক ফলাফল :-
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে শিল্প বিপ্লব বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও জার্মানিতে প্রসার লাভ করে। এই সব দেশের শিল্পোন্নয়নের প্রাথমিক যুগের উদ্যোক্তা এবং মূলধনের মুখ্য ভূমিকা ছিল। ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ উদ্যোক্তা উইলিয়াম কক্ রিল বেলজিয়ামে প্রথম সুতাকল স্থাপন করেন। ইংরেজি পুঁজিপতিদের সাহায্যে বেলজিয়ামের প্রথম রেলপথ নির্মিত হয়। অল্পকালের মধ্যেই বেলজিয়ামে বহু কলকারখানা গড়ে ওঠে। ফরাসি বিপ্লবের পূর্ববর্তীকালে ফ্রান্সের কোন বিষেশ কলকারখানা ছিলনা। উৎপাদন ছিল সর্বতোভাবে কুটির শিল্প ভিত্তিক নেপোলিয়নই সর্বপ্রথম ফ্রান্সে শিল্প বিপ্লবের ভিত্তি স্থাপন করে। যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন ও যন্ত্রের সাহায্যে উৎপাদনের জন্য তিনি সরকারি উৎসাহদানের ব্যবস্থা করেন। এই উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি প্যারিসে একটি কারিগরি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। জুলাই রাজতন্ত্রের আমলে প্রকৃতপক্ষে ফ্রান্সে শিল্প বিপ্লব শুরু হয।
শিল্প বিপ্লবের রাজনৈতিক প্রভাব বা ফলাফল :-
শিল্পবিপ্লব রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল। শিল্প বিপ্লবের আগে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভূস্বামী অভিজাতরাই সকল ক্ষমতা ভোগ করত, কিন্তু পরবর্তীকালে মূলধনী ও শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক প্রতিপত্তি লাভে উদ্যোগী হয়। পূর্বে ভোটাধিকার সম্পত্তির মালিকানার সংস্কারের দাবি ওঠে এবং ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডবাসীর আন্দোলনের সফলতার পর ইউরোপের দেশে দেশে এই আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে।
১) গণতান্ত্রিক আদর্শ :-
এতদিন গণতান্ত্রিক আদর্শ বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিত মানুষদের চিন্তা ও চেতনার আবদ্ধ ছিল, কিন্তু শিল্প বিপ্লবের পর মূলধনী ও শ্রমিক শ্রেণী গণতান্ত্রিক অধিকার দাবী করতে থাকে। নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য ইংল্যান্ডের শ্রমিকরা 'চার্টিস্ট আন্দোলন' শুরু করে। একইভাবে নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য বিভিন্ন দেশে শুরু হয় 'ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন'। মালিক শ্রেণির শোষনে জর্জরিত হয়ে শ্রমিকরা কালক্রমে উপলব্ধি করতে পারে যে তাদের জীবনের দুঃখ কষ্ট লাঘবের জন্য সঙ্ঘবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের মাধ্যমে কিছু কিছু দাবি আদায়ে সমর্থ হয়। অবশ্য এতে শ্রমিক অসন্তোষ সম্পূর্ণ প্রশমিত হয়নি। ফলে শ্রমিক আন্দোলন স্থায়ী রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়।
২) সমাজতন্ত্রবাদ আদর্শ :-
শিল্প বিপ্লবের ফলে 'সমাজতন্ত্রবাদ' নামক নতুন রাজনৈতিক দর্শন বিকশিত হয়। সমাজে ধনবন্টন ব্যবস্থার বৈষম্য, শ্রমিকশ্রেণীর সীমাহীন দুর্দশা ও শিল্পপতিদের হাতে দেশের অধিকাংশ সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে যে সমস্যার উদ্ভব হয়, তার সমাধানকল্পে কিছু কিছু চিন্তাবিদ সমাজতান্ত্রিক আদর্শ প্রচার করতে শুরু করেন। তাদের মতে, উৎপাদনের উপাদানে সকলের সমান অধিকার থাকা উচিত এবং আয় বণ্টনের সমতা থাকা জরুরী। পরে কার্ল মার্কস এই মতবাদকে আরো বিজ্ঞানসম্মত ভাবে প্রচার করেন। তিনি এর নাম দেন 'সাম্যবাদ' শোষিত। বঞ্চিত শ্রমিকশ্রেণী খুব সহজেই সাম্যবাদে বা সমাজতন্ত্রবাদে আকৃষ্ট হয়। সাম্যবাদের আদর্শে উদ্ভূত হয়ে রাশিয়া, চীন প্রভৃতি দেশে শ্রমিক শ্রেণি আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়েছে। দেশেও এই রাষ্ট্রদর্শন ক্রমশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
৩) জাতীয়তাবাদী আদর্শ :-
শিল্প বিপ্লবের ফলে জাতীয়তাবাদী আদর্শ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এতদিন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন ধরনের আঞ্চলিক শুল্ক - ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। শিল্প বিপ্লবের ফলে সমগ্র দেশে একই শিল্পনির্ভর অর্থনীতি চালু হলে জাতীয় সংহতি গড়ে ওঠে। এবং জাতীয়তাবাদের পথ প্রশস্ত হয়। অপরদিকে, জাতীয়তাবাদের অগ্রগতি আন্তর্জাতিকতাবাদের পথকে প্রশস্ত করে। উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা, বাণিজ্যিক কারণে বিভিন্ন দেশ ও জাতিরবর্গের মধ্যে ঘনিষ্ঠতর যোগাযোগ আন্তর্জাতিকতাবাদের উন্মেষ ঘটায়।
৪) ঔপনিবেশিক প্রতিদন্ধিতা :-
শিল্পোন্নত দেশগুলি নিজেদের দেশে উৎপন্ন উদ্বৃত্ত পণ্যাদি বিক্রির জন্য ইউরোপ ও তার বাইরে পৃথিবীর নানা দেশে বাজার খুঁজতে গিয়ে সেখানে উপনিবেশ স্থাপন করতে থাকে। এরফলে তাদের মধ্যে তীব্র ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। এই উপনিবেশ দখলের লড়াই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমস্যাবলীর সৃষ্টি করে।
উপসংহার :-
শিল্প বিপ্লবের উপরিউল্লেখিত ফলাফল গুলি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কারণ, শিল্প বিপ্লব ধারাবাহিক ঘটনা। ফলে অষ্টাদশ শতকে শিল্পবিপ্লবের প্রকৃতি ও তার ফলাফল বিংশ শতকে এসে আবার নতুন চরিত্র পরিগ্র করতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে অষ্টাদশ শতক ও বিংশ শতকের ফলাফলের মধ্যেও যোগসূত্র নিশ্চয়ই খুঁজে নেওয়া যাবে। যাইহোক, শিল্প বিপ্লব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন সূচনা করে।
0 মন্তব্যসমূহ