আজাদ হিন্দ ফৌজ (Indian National Army)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রখ্যাত ভারতীয় বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর উদ্যোগে আজাদ হিন্দ ফৌজ বা বাহিনী (Azad Hind Fauj) সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু এই বাহিনীর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতিষ্ঠাতায় ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। এই সেনাবাহিনী লক্ষ্য ছিল ভারত থেকে ব্রিটিশদের উচ্ছেদ সাধন করে দেশকে ঔপনিবেশিক শাসনজাল থেকে পুরোপুরি মুক্ত করা ।
INDEX:
- ভূমিকা
- আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা
- আজাদ হিন্দ ফৌজে নারী বাহিনীর ভূমিকা
- আজাদ হিন্দ বাহিনীর ভারত অভিযান
- আজাদ হিন্দ বাহিনীর ভারত অভিযানে সরকারের ভুমিকা
- আজাদ হিন্দ বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ
- সরকার গঠন
- আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অধিকার
- দিল্লি যাত্রার উদ্যোগ
- কোহিমা দখল
- আজাদ হিন্দ বাহিনীর ব্যর্থতার কারণ
- আজাদ হিন্দ বাহিনীর আত্মসমর্পণ
- ফলাফল
- গুরুত্ব
- ব্রিটিশরাজের মৃত্যুঘণ্টা বাজানাে
ভূমিকা :-
ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা গঠিত একটি সশস্ত্র সেনাবাহিনী হলো আজাদ হিন্দ ফৌজ বা ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এই বাহিনী গঠিত হয় ।
এই সেনাবাহিনী লক্ষ্য ছিল মূলত জাপানের সাহায্যে ভারত থেকে ব্রিটিশদের উচ্ছেদ সাধন করে দেশকে ঔপনিবেশিক শাসনজাল থেকে পুরোপুরি মুক্ত করা । এই বাহিনী সাধারণত জাপানের হাতে ধরা পড়া ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে সংঘটিত হয়েছিল ।
আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা :-
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রখ্যাত ভারতীয় বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর উদ্যোগে আজাদ হিন্দ ফৌজ বা বাহিনী সংঘটিত হয়েছিল। আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠনের পরিকল্পনা করেন রাসবিহারী বসু। কিন্তু এই বাহিনীর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতিষ্ঠাতায় ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। বলা হয় এই বাহিনীর সরকারের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু।
আজাদ হিন্দ ফৌজে নারী বাহিনীর ভূমিকা :-
আজাদ হিন্দ বাহিনীর দায়িত্ব গ্রহণ করে নেতাজি এই বাহিনীর পুনঃগঠনের কাজে হাত দেয়। এবং নেতাজি আজাদ হিন্দ বাহিনীকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেন।
যথা: 'গান্ধি ব্রিগেড', 'আজাদ ব্রিগেড', 'নেহেরু ব্রিগেড' প্রভৃতি।
বালক-বালিকাদের নিয়ে বাল সেনা দল এবং নারীদের নিয়ে 'ঝাঁসির রানী ব্রিগেড' গঠিত হয়।
এই ঝাঁসির রানী ব্রিগেড এ নেতৃত্ব দেন শ্রীমতি লক্ষ্মী স্বামীনাথন। ওরফে ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী ।
তিনিই ছিলেন প্রথম আজাদ হিন্দ বাহিনীর ক্যাপ্টেন। ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন এই বীরাঙ্গনা। নেতাজি অনুগামীদের প্রবল ইচ্ছায় শেষ পর্যন্ত নিজের নামে নেতাজি "সুভাষ ব্রিগেড" গঠন করেন।
২৩ শে জানুয়ারি ১২৩ তম জন্মদিনে স্কুপিপোস্টের নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর তরফে থাকল লক্ষ্মী স্বামীনাথন সেহগল লড়াইয়ে কাহিনী। স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীও ছিলেন লক্ষ্মী সেহগল ।
১৯৯৮ সালে তাকে পদবি ভূষণ দেওয়া হয়।
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ সিঙ্গাপুরে সেইসময় মাদ্রাজের মেয়ের লক্ষ্মী স্বামীনাথন চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছেন।
নেতাজীর সঙ্গে সেখানেই তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামে লড়াইয়ে নারীর অংশগ্রহণ প্রয়োজন বলে হলে সে সময় বক্তৃতায় বারবার জানিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। দেশের জন্য কিছু করার চিন্তা তার মধ্যে সর্বত্রই ছিল।
ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স লীগের সভাপতি ইয়েলাপ্পা সেই সময় লক্ষ্মীকে জানান, এবং নেতাজী তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছে। এরপর থেকেই শুরু হয় ভারতের মুক্তি সংগ্রামের বীরাঙ্গনা লক্ষ্মী লড়াই।
লক্ষ্মী স্বামীনাথন ১৯১৪ সালে মাদ্রাজে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন হাইকোর্টের ক্রিমিনাল- ল-ইয়ার। এবং সমাজ কর্মী ছিলেন লক্ষ্মী স্বামীনাথন এর মা। মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজ থেকে এম-বি-বি-এস পাশ করেন। এবং চিকিৎসা শুরু করেন।
লক্ষ্মীকে একটা গুরুদায়িত্ব দেন সুভাষচন্দ্র।
নারীবাহিনীর নেতৃত্বের দায়িত্ব এসে পড়ে তার ওপর। নেতাজি লক্ষ্মী স্বামীনাথন কে ডেকে পাঠানো ঠিক তিনদিন পরে গঠিত হয় নারীবাহিনী। নেতাজি আসছেন শুনে লক্ষ্মী স্বামীনাথন শাড়ির আচল কোমরে গুঁজে রাইফেল নিয়ে গার্ড অফ অনার দিয়েছিলেন তিনি। এবং তার সাথে ছিল অন্যান্য মহিলারা।
খুব কম সময়ের মধ্যেই তাদের কাজে সুভাষচন্দ্র বসু খুব খুশি হয়েছিলেন। সুভাষ লক্ষ্মীকে ডেকে বলেন খুব ভেবেচিন্তে কাজ করতে হবে এবং বার্মা জঙ্গলে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হবে আমাদের।
প্রশ্ন ছিল, ঠিক কবে থেকে কাজ শুরু করতে পারবে?
অপরদিকে লক্ষ্মীর উত্তর ছিল আগামীকাল থেকেই।
নেতাজী তাঁদের বলেছিলেন, ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাই যেভাবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন, ঠিক তেমনটাই পারতে হবে।
তিনি এও বলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের নারী বাহিনীর নাম ছিল ঝাঁসি বাহিনী।
শুরু হয় নারী বাহিনীর ট্রেনিং।
মনের জোর ও দেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন বীরাঙ্গনার হয়ে উঠেছিল অস্ত্র চালনার পটু। সমস্ত ইংরেজদের মধ্যে যা ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। নারী বাহিনী সমস্ত মহিলার স্বেচ্ছায় তাদের চুল বিসর্জন দিয়েছিল।
স্বাধীনতার জন্য যে নারী বাহিনী মৃত্যুবরণের ভয় পায়না, তাদের কাছে চুল বিসর্জন ছিল সামান্যই বিষয় মাত্র। ট্রেনিং এর সূচনা পর্বে ভারতীয় নারীর বীরত্বে যথেষ্ট মুগ্ধ হয়েছিলেন জাপানি অফিসাররাও।
সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৪৩ সালে ২১ অক্টোবর সিঙ্গাপুরে "আজাদ হিন্দ সরকার " নামে স্বাধীন ভারত সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। এবং লক্ষ্মী সেহগল এই সরকারের প্রথম মহিলা মন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন। এবং নেতাজি ছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে।
ইম্ফলে রণাঙ্গনে যেতে চায় ঝাঁসির বাহিনী এই কারণে সিঙ্গাপুর থেকে রেঙ্গুনে আনা হয়েছিল তাদের। এবং বাছাই করা একটি বাহিনীকে পাঠানো হয়েছিল ঘাঁটি মেমিউতে।
এই বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং লক্ষ্মী সেহগল। ইংরেজদের বোমাবর্ষণ মেমিউর যুদ্ধ ঘাঁটি একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়। ধরা পড়েন শেষ পর্যন্ত ইংরেজদের হাতে লক্ষ্মীসহ ঝাঁসি বাহিনীর অন্যান্যরাও।
সেই সময় ভারতীয় নারী বাহিনীর দাপটে ইংরেজরাও স্তম্ভিত হয়ে যায়। এবং বার্মার কারাগারে ১৯৪৬ সালে পর্যন্ত বন্দি ছিলেন এবং পরে ছাড়া পান।
১৯৪৭ সালে দ্বিতীয়বার কর্নেল প্রেম সাইগলকে বিয়ে করেন লক্ষ্মী স্বামীনাথন। এবং পরবর্তীতে স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে সমাজসেবা মূলক কাজে নিযুক্ত হয়। সি. পি. এম এ ১৯৭১ সালে যোগ দেন।
রাজ্যসভায় দলের প্রতিনিধিত্ব করেন, ইত্যাদি কাজে নিযুক্ত হয়ে দেশের জনগণের পাশে দাঁড়ায় লক্ষ্মী স্বামীনাথন। এবং ১৯ জুলাই ২০১২ সালে ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগল হৃদযন্ত্র জনিত রোগে আক্রান্ত হন। এবং অবশেষে ৯৭বছর বয়সে ২৩ জুলাই ২০১২ তারিখে ১১:২০ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন কানপুরে।
মৃত্যুর পরেও তিনি তার দেহ কানপুর মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎশাস্ত্রের প্রয়োজনে দান করেন।
অবশেষে আমরা বলতে পারি যে, স্বাধীন ভারতের মুক্তি সংগ্রামে নারী বাহিনীর ভূমিকা ছিল অগণ্য।
আজাদ হিন্দ বাহিনীর ভারত অভিযান :-
I. আজাদ হিন্দ বাহিনীর ভারত অভিযানে সরকারের ভুমিকা :-
ভারতবর্ষে যখন হিন্দু-মুসলমান তাদের নিজ নিজ ক্ষমতা দখলের দ্বন্ধে ক্ষতবিক্ষতে জর্জরিত। এবং জাতীয় নেতৃবৃন্দ তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা বাঁচাতে মরিয়া হয়ে পড়ে।ঠিক সেই সময় ভারতমাতারই এক বীর সন্তান নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর সমস্ত জীবন উৎসর্গ করে দেয়। বিদেশের মাটি থেকে দেশমাতার মুক্তির উদ্দেশ্যে।
সিংহাসন লাভ নয়, ভারতমাতার মুক্তিই ছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্রের জীবনে তার একমাত্র সাধনা।
II. আজাদ হিন্দ বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ :-
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই সিঙ্গাপুরে এক বিশাল জনসভায় রাসবিহারী বসু সুভাষচন্দ্রকে ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স লীগ এর দায়িত্বভার দেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ২৫ শে আগস্ট আজাদ হিন্দ বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
III. সরকার গঠন :-
নেতাজি সুভাষচন্দ্র ২১ অক্টোবর ( ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ) সিঙ্গাপুরে ‘আজাদ হিন্দ সরকার’ নামে স্বাধীন ভারত সরকার প্রতিষ্ঠার কথা ঘােষণা করেন ।
এই সরকার ২৩ অক্টোবর ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে । কয়েকদিনের মধ্যেই জাপান, জার্মানি, থাইল্যান্ড, ইতালি, ক্রোয়েশিয়া, বার্মা, কুয়াে - মিন - তাং চিন, ফিলিপিনস, মাঞ্চুরিয়া প্রভৃতি নয়টি রাষ্ট্র আজাদ হিন্দ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়।

আজাদ হিন্দ পতাকা
IV. আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অধিকার :-
জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিদেকি তােজো ৬ নভেম্বর ( ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ) আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দুটি আনুষ্ঠানিকভাবে আজাদ হিন্দ সরকারের হাতে তুলে দেন।
নেতাজি ৩১ ডিসেম্বর এই দুটি দ্বীপপুঞ্জের নাম রাখেন যথাক্রমে 'শহিদ ’ ও ‘স্বরাজ ’।
V. দিল্লি যাত্রার উদ্যোগ :-
নেতাজি ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দের ৪ জানুয়ারি রেঙ্গুন - এ যান । সেখানে তার প্রধান সামরিক দপ্তর স্থাপিত হয় ।
আজাদ হিন্দ বাহিনী এরপর ভারত অভিযানে অগ্রসর হয় । সেনাদলের সামনে নেতাজি ধ্বনি দেন “দিল্লি চলাে " , কারণ দিল্লি ভারতের রাজাধানী।
VI. কোহিমা দখল :-
জাপানি নেতৃবৃন্দের সহযােগিতায় , নেতাজির বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এবং উজ্জীবনী মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে আজাদ হিন্দ বাহিনী (Azad Hind Fauj) প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ চালান। তারা মণিপুরের কোহিমা শহরটি দখল করে ৬ এপ্রিল, ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে এবং রাজধানী ইম্ফল দখলের জন্য অগ্রসর হয় ।
আজাদ হিন্দ বাহিনী অভিযান চালিয়ে ভারতের সীমানা থেকে প্রায় ১৫০ মাইল অভ্যন্তর পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসন মুক্ত করতে সক্ষম হয়।
আজাদ হিন্দ বাহিনীর ব্যর্থতার কারণ :-
নেতাজি সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ বাহিনী বেশ কিছু কারণে ব্যর্থ হয়। কারণগুলি নিম্নে আলোচনা করা হল।-----I. যোগাযোগ ব্যবস্থার বিচ্ছেদ :-
দুর্গম পার্বত্য এলাকায় যুদ্ধ পরিচালনার নানান অসুবিধাহয়। এবং জাপানের প্রত্যাবর্তনের আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনারা অরক্ষিত হয়ে পড়ে।
তাছাড়া নির্দিষ্ট সময়ের আগেই প্রবল বর্ষা নামায় আজাদ হিন্দ বাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
II. খাদ্যদ্রব্যের অভাব :-
সময়ের আগেই বর্ষা হওয়াই এবং সৈনিকদের ন্যূনতম খাদ্য ও রসদের অভাব হয়। ফলে আজাদ হিন্দ বাহিনী চূড়ান্ত বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়।
অস্ত্রশস্ত্র, খাদ্য ও সরঞ্জামের অভাবের ফলে আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈন্যরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এবং প্রবল শীত, ম্যালেরিয়া, পার্বত্য অঞ্চলের বিষাক্ত পোকামাকড়ের কামড় কারণে কয়েক হাজার আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনার মৃত্যু হয়।
III. যুদ্ধে কোণঠাসা জাপান :-
নেতাজির নেতৃত্বে এবং জাপানের সহায়তায় আজাদ হিন্দ বাহিনী ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে থাকে। তখন দুর্ভাগ্যক্রমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের অবস্থা ভিন্নদিকে মােড় নিতে শুরু করে ।
আমেরিকা বিপুল শক্তি নিয়ে জাপানের দিকে এগিয়ে এলে, কোণঠাসা জাপানি সেনা ও বিমানবাহিনী স্বদেশ রক্ষার্থে প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে রওনা হয়।
জাপানের প্রত্যাবর্তন ও সামরিক বিপর্যয়ে আজাদ হিন্দ সেনাদের মনােবল ভেঙে যায়। তবুও সীমাহীন আশাবাদী নেতাজি বলেন ,
“আমরা অন্ধকারতম মুহূর্ত অতিক্রম করেছি, সূর্যোদয়ের আর দেরি নেই , ভারত স্বাধীন হবেই।”
IV. এ. এম নায়ারের বক্তব্য :-
ঐতিহাসিক এ. এম নায়ারের এর মতে, জাপান ও সুভাষ চন্দ্র বসু যেই সময় ভারত অভিযান পরিকল্পনা করেছিলেন সেই সময়টা উপযোগী ছিল না। এবং রণকৌশল ছিল যথেষ্ট ত্রুটিপূর্ণ।
V. আজাদ হিন্দ বাহিনীর আত্মসমর্পণ :-
এই সময় ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর আক্রমণে জাপান বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল। এবং জাপানের সাহায্য পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলে শেষ পর্যন্ত জাপান ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে, আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনারাও অস্ত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
ফলাফল :-
আজাদ হিন্দ বাহিনী তার ঘোষিত লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হলেও, ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস আজাদ হিন্দ বাহিনীর অভিযানের ফলাফল ছিল সুদূর প্রসারী।
- আজাদ হিন্দ বাহিনীর স্বাধীনতা সংগ্রামের তাৎক্ষণিক ফলস্বরূপ ভারতীয় নৌ- সেনারা বিদ্রোহের সূচনা ঘটায়।
- ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় নৌ- সেনাদের বিদ্রোহের পর, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ সরকারের প্রধান হিসেবে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার দাবিকে একটি আন্তর্জাতিক প্রশ্নে পরিণত করে।
- ভারতীয় জনগণের ওপর আজাদ হিন্দ এর প্রভাব এক ভয়ংকর রূপ ধারণ করে।
গুরুত্ব :
ভারতের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রবল বিক্রম ও ত্যাগ - তিতিক্ষার অনুরূপ দৃষ্টান্ত খুবই বিরল।
ড . রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন যে ,
ব্যর্থতা সত্ত্বেও ভারতের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে আজাদ হিন্দ বাহিনী এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।
এর গুরুত্বগুলি হল —
I. আংশিক স্বাধীনতা লাভ :
খাদ্য ও রসদপত্রের অভাব , প্রবল প্রতিকূল পরিবেশ এবং বাধাবিঘ্ন উপেক্ষা করে আজাদ হিন্দ বাহিনী ভারতের উত্তর - পূর্ব সীমান্তের ১৫০ মাইল অভ্যন্তর পর্যন্ত অঞ্চল স্বাধীন করতে সক্ষম হয় ।
II. ব্রিটিশরাজের মৃত্যুঘণ্টা বাজানাে :-
ব্যর্থতা সত্ত্বেও আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনারা যুদ্ধে যে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিল তাতে ব্রিটিশ সরকার উপলব্ধি করেছিল যে , ভারতে তাদের দিন ফুরিয়ে এসেছে । এখন শুধু বিদায় নেওয়ার অপেক্ষা ।
III. জাতীয়তাবাদের সঞ্চার :
আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রবল বীরত্ব ও আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত দেশবাসীর মনে প্রবল জাতীয়তাবাদী আশা - আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তােলে । দিল্লির লালকেল্লায় বন্দি আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনাদের বিচার শুরু হলে সারা দেশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে।
তেজবাহাদুর সপু , ভুলাভাই দেশাই , জওহরলাল নেহরু , কৈলাসনাথ কাটজু , আসফ আলি প্রমুখ কংগ্রেসি নেতা বন্দি আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনাদের সমর্থন করেন । প্রবল গণবিক্ষোভের ফলে বন্দি সেনারা মুক্তি পায় ।
IV. প্রেরণার সঞ্চার :
আজাদ হিন্দ বাহিনীর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে কিছুকাল পরে ভারতে নৌবিদ্রোহ ঘটে এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীতে প্রবল অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একসময় বলেছিলেন ,
সুভাষচন্দ্র , বাঙালি কবি আমি , বাংলাদেশের হয়ে তােমাকে দেশনায়কের পদে বরণ করি । গীতায় বলেন , সুকৃতের রক্ষা ও দুষ্কৃতের বিনাশের জন্য রক্ষাকর্তা বারংবার আবির্ভূত হন । দুর্গতির জালে রাষ্ট্র যখন জড়িত হয় তখনই পীড়িত দেশের অন্তর্বেদনার প্রেরণায় আবির্ভূত হয় দেশের দেশনায়ক ।
কবিগুরুর কথা মিথ্যা হয়নি ।
গান্ধিজি ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জানুয়ারি সুভাষচন্দ্রকে
‘প্রথম ভারতীয় ও শেষ ভারতীয়'
বলে বর্ণনা করেন ।
Source:[Wikipedia];[Britannica];[Source]
1 মন্তব্যসমূহ
Abul
উত্তরমুছুন