কলকাতা কেন্দ্রিক নবজাগরণ

কলকাতা কেন্দ্রিক নবজাগরণ

ঊনবিংশ শতকে বাংলার নবজাগরণ ঘটেছিল। যদিও এই নবজাগরণের প্রথম সূচনা ঘটে ছিল ফ্রান্সে

bengali-renaissance


সমকালীন বাংলাদেশের সকল শ্রেণীর প্রাচীন প্রথাকে ভেঙ্গে ফেলে নতুনের আলোকে সমাজ গড়ে তোলার আদর্শ তৈরি হয়েছিল। সে যুগে বঙ্কিমচন্দ্র, মধুসূদন, ডিরোজিও, বিদ্যাসাগররাজা রামমোহন রায় নবজাগরণে  এক আদর্শ সৃষ্টি করেছিলন। 

সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ এক নতুন জীবনের আলো দেখেছিল। শিক্ষা, সমাজ, রাজনীতি, নারী জাতি, সব ক্ষেত্রেই নবজাগরণের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল।

INDEX

  1. ভূমিকা বা সূচনা
  2. বঙ্গীয় নবজাগরণের সংজ্ঞা
  3. নবজাগরণ এর অর্থ
  4. রাস্মরণীয় ব্যক্তি
  5. ঊনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের চরিত্র ও প্রকৃতি ও পর্যালোচনা
  6.  ইতালিয় রেনেসাঁসের সঙ্গে বাংলার নবজাগরণের পার্থক্য
  7. ইউরোপীয় রেনেসাঁস
  8. কলকাতা কেন্দ্রিক নবজাগরণ ভাবনার বাইরে বেরোনোর প্রয়াস আজও উপক্ষিত থেকে গেল
  9. বাংলা নবজাগরণ ছিল কলকাতা শহর কেন্দ্রিক মন্তব্যটি বিশ্লেষণ 
  10. বাংলায় নবজাগরণের বৈশিষ্ট্য
  11. নবজাগরণের ত্রুটি
  12. অনুকূল পরিস্থিতি অভাব 
  13. নবজাগরণের সীমাবদ্ধতা
  14. গুরুত্ব

     



ভূমিকা বা সূচনা :- 

 ঊনবিংশ শতকে বাংলার নবজাগরণ ঘটেছিল। যদিও এই নবজাগরণের প্রথম সূচনা ঘটে ছিল ফ্রান্সে।
এরপর ইংল্যান্ডে অষ্টাদশ শতকে এর সূচনা হয়। অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডের নবজাগরণের পরোক্ষভাবে এসে পড়েছিল ভারতবর্ষে তথা সমকালীন বাংলাদেশে।
সমকালীন বাংলাদেশের সকল শ্রেণীর প্রাচীন প্রথাকে ভেঙ্গে ফেলে নতুনের আলোকে সমাজ গড়ে তোলার আদর্শ তৈরি হয়েছিল। সে যুগে বঙ্কিমচন্দ্র, মধুসূদন, ডিরোজিও, বিদ্যাসাগর, নবজাগরণ এক আদর্শ সৃষ্টি করেছিলন।
সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ এক নতুন জীবনের আলো দেখেছিল। শিক্ষা, সমাজ, রাজনীতি, নারী জাতি, সব ক্ষেত্রেই নবজাগরণের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল।
পরবর্তীকালে এই নবজাগরণ এক বিস্তৃত পথ তৈরি করে দিয়েছিল। আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা বা জীবনযাত্রা যাকে নিয়ে গর্ব করে তা হল এই নবজাগরণ। 

বঙ্গীয় নবজাগরণের সংজ্ঞা :- 

বঙ্গীয় নবজাগরণ বলতে মূলত চোদ্দো-ষোল শতকের ইতালিয় সাহিত্য, শিল্পকলা, বিজ্ঞান ও রাজনীতির বিকাশ কে বোঝায় এবং অপরদিকে পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে এসে ঊনিশ শতকের মধ্যবিত্ত বাঙালির সমাজে এক যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী আড়োলনের সূচনা দেখা দেয়। এর ফলে তৎকালীন সমাজে ধর্ম, শিক্ষা, সাহিত্য, দর্শন  রাজনীতি জীবনের সর্বক্ষেত্রেই ব‍্যাপক পরিবর্তন দেখা যায় বা পরিলক্ষিত হয় তাঁকেই সাধারণত ঐতিহাসিকরা "বঙ্গীয় নবজাগরণ" বা "Bengal Renaissance" বলে অভিহিত করেছেন। 


নবজাগরণ এর অর্থ :- 

"রেনেসাঁস" একটি ফরাসি শব্দে। এর বাংলা অর্থ হল "নবজাগরণ।" এই কথাটির বুৎপত্তিগত অর্থ হল পুর্নজন্ম। এই রেনেসাঁস শব্দটি সাধারণত ইউরোপের ইতিহাসের সঙ্গে মিলিত ছিল। নবজাগরণ বলতে সাধারণত ভাবে প্রাচীন গ্রিক , রোমান সাহিত্য  দর্শন শিল্পকলা জানার অদম্য উৎসাহ কে বোঝায়। কিন্তু ব‍্যাপক অর্থে রেনেসাঁস হল ব্যক্তিত্বের পুর্নজন্ম অর্থাৎ এক নতুন, স্বাধীন, সাহসিকতাপূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ, যুক্তিবাদী চেতনা ও অনুসন্ধিসার বিকাশ। 

স্মরণীয় ব্যক্তিরা:-

রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, নাগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, আলেকজান্ডার ডাফ, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাদম্বিনী গাঙ্গুলী, বিহারীলাল চট্টোপাধ্যায়, গিরিশচন্দ্র, শ্রী অরবিন্দ ইত্যাদি ইতিহাসবিদদের নাম বাংলার নবজাগরনের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। 

ঊনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের চরিত্র ও প্রকৃতি ও পর্যালোচনা :-

পাশ্চাত্য সভ্যতা সংস্পর্শে এসে বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজে এক আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি হয় যার মূল ভিত্তি ছিল যুক্তি ও মানবতাবাদ। সমকালিন শিক্ষা, সাহিত্য, ধর্ম, সমাজে সবকিছুই  তা গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
কনস্ট‍্যান্টিনোপলের পতনের পর ১৫ ও ১৬ শতাব্দীতে ইতালিতে যে রেনেসাঁস বা নবজাগরণের উন্মেষ ঘটেছিল তার সঙ্গে তুলনা করে বাংলার এই বিকাশকেও "নবজাগরণ" অ‍্যাখ‍্যা দেওয়া হয়েছে। 
নবজাগরণের চরিত্র নির্ণয়ের প্রশ্নের পণ্ডিতদের মধ্যে বিতরকের অন্ত নেই। আবার আদও একে নবজাগরণ বলা উচিত কিনা বা ইউরোপীয় রেনেসাঁস ও বাংলার রেনেসাঁস সমগোত্রীয় কিনা এই প্রশ্নটি বিতর্কিত। 
ঊনিশ শতকে সাহিত্য, শিল্প, মননশীলতা, সমাজ, ধর্ম সংস্কারের ক্ষেত্রে নবজাগরণ ঘটে তা প্রথমে বাংলাদেশ দেখা দিলেও ক্রমে তা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলার নবজাগরণ নিয়ে দুটি বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। 
একটির মত অনুসারে নবজাগরণ ছিল স্বার্থক ও সফল। অন‍্যটির অনুসারে এটি ছিল মূলত একটি আরোপিত ব‍্যাপার। বাংলার নবজাগরণকে রেনেসাঁস বলা যায় কিনা তা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। 
 উনিশ শতকের নবজাগরণকে ব‍্যাখ‍্যা করার জন্য কেশবচন্দ্র সেন, বিপিনচন্দ্র পাল, প্রভৃতি নেতা সর্বপ্রথম "রেনেসাঁস" কথাটি ব্যবহার করেন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে  স‍্যার যদুনাথ সরকার তার "History of Bengal" এর দ্বিতীয় খন্ডে দ্বিধাহীন ভাবে ১৯ শতকের বাংলা নবজাগরণকে "রেনেসাঁস" বলেছেন। 
যদুনাথ সরকার বলেন 
" It was truly Renaissance wider deeper become and more revolutionary than that of Europe after the fall of Constantinople...."

এরপর অমিত সেন ছদ্মনামে অধ্যাপক সুভাষচন্দ্র সরকার তার " No of Bengal Renaissance " ( ১৯৪৬ ) বলেন বাংলাদেশেই সর্বপ্রথম ব্রিটিশ শাসন, বুর্জোয়া অর্থনীতি ও আধুনিক পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব অনুভূতি হয়। তার ফলে জাগরণ ঘটে থাকে সাধারণত "রেনেসাঁস" বলা হয়ে থাকে। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করলে ১৫ শতকে ইতালির রেনেসাঁসের আলোকে ১৯ শতকের বাংলার রেনেসাঁসকে বিচার করা ভুল। উভয়েরই প্রেক্ষাপট ও চরিত্র আলাদা।
অধ‍্যাপক সুশোভন সরকার যথার্থই বলেছেন যে, 
"আমাদের রেনেসাঁস আন্দোলন কে বৈদেশিক ধারা উপনিবেশিক শাসনের কাঠামোর মধ্যে বিকাশ লাভ করতে হয়। সুতরাং প্রাচীন সংস্কৃতির পুর্ন মূল্যায়ন করে প্রাচীন সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠা প্রাণদায়িনী শ্রোতে অবগাহন করতে আমাদের নবজাগরণ তার পূর্ণ প্রাণশক্তি লাভ করতে পারেননি। বাংলার নবজাগরণের প্রকৃতিকে স্বতন্ত্র ইউরোপীয় রেনেসাঁসের সঙ্গে তুলনা না করে আলাদা ভাবে এটা করা উচিত।" 

অধ্যাপক সরকারের মতে,

" বাংলার নবজাগরণের আমরা দুটি পৃথক ধারা সমন্বয় দেখতে পাই। যথা পাশ্চাত্য উদারপন্থী ভাবধারা এবং পূর্ণরুজ্জীবনবাদী প্রাচ্যবাদী। প্রথম ভাব ধারার প্রভাবে সমাজ সংস্কারের চেষ্টা সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন, নারী মুক্তি আন্দোলনের প্রকৃতি ঘটে। দ্বিতীয় ধারা অর্থাৎ পূর্ণরুজ্জীবনবাদী অনুযায়ী বলা যায় যে সরকারি আইন এর সাহায্যে সামাজিক কুসংস্কার ও কুপ্রথারদ করার চেষ্টায় ভুল নীতি, সরকারের হস্তক্ষেপই তা দূর হতে পারে। নরহরি কবিরাজ সঠিকভাবে মন্তব্য করেছেন "
 

বাংলার নবজাগরণের চরিত্র ছিল বুর্জোয়া জাতি জাগরণ। এই জাগরণের মধ্যে জনগণের জাগরণের চিহ্ন খুঁজে বেড়ানো এর মধ্যে বৃহত্তর কৃষক সমাজের আশা-আকাঙ্ক্ষা পরিতৃপ্তি সন্ধান করা ও অনৈতিহাসিক দৃষ্টির পরিচয়। উপনিবেশে পরিমণ্ডলে একটি পরাধীন জাতির মধ্যে গড়ে ওঠা বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের পক্ষে কখনই সীমাবদ্ধতা থেকেও স্ববিরোধিতা থেকে মুক্ত হয়ে ওঠার প্রত্যাশা নিরর্থক।

প্রশ্ন হলো সমাজ বিকাশের ক্ষেত্রে নবজাগরণ দেশকে অগ্রগতির পথ দেখাতে পেরেছিল কিনা, বিশ্ব বিকাশের মূল স্রোতের সঙ্গে ভারতের যোগসাধন ঘটাতে পেরেছিল কিনা, যুক্তি ও মানবতাবাদ আধুনিকতা স্রোতে দেশকে তা গ্রহণ করতে সাহায্য করেছিল কিনা, যতই সীমাবদ্ধতা ও স্ববিরোধিতা থাকুক না কেন এই কাজে বাংলা নবজাগরণ ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছিল এ বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই ; এর মধ্যে নিহিত আছে বাংলা নবজাগরণ এর সার্থকতা ও ঐতিহাসিক মূল্য। 

 ইতালিয় রেনেসাঁসের সঙ্গে বাংলার নবজাগরণের পার্থক্য :-

 ইতালির রেনেসাঁসের সঙ্গে বাংলা নবজাগরণের তুলনা করে বলা হয় মধ্যযুগের তন্দ্রা, আত্মবিশ্বাস, কুসংস্কার থেকে যেমন রেনেসাঁসের ইতালীয় প্রথম মুক্তির পথ দেখায় তেমনি ভারতে মধ্যযুগীর আত্মবিশ্বাস ও কুসংস্কার থেকে ঊনিশ শতকে বাংলায় নবজাগরণ মুক্তির পথ দেখায়।

 ১| ইতালিয় রেনেসাঁস ধ্রুবদী সাহিত্য যথা গ্রীক,ও ল্যাটিন সাহিত্যের যে ব্যাপক চর্চা হয়, বাংলাতেও প্রাশ্চ‍্যবাদীরা এরুপ ভারতে প্রাচীন সংস্কৃত ও মধ্যযুগের ফরাসি সাহিত্যের চর্চা করেন। 

 ২| অপরদিকে পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সাহিত্য গ্রিক ও ল‍্যাটিন সাহিত‍্যের জ্ঞান ভান্ডার ইংরেজি সাহিত্যের মধ্য দিয়ে বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। 

 ৩| ইতালি রেনেসাঁস যে স্বাধীন অনুসন্ধানী, যুক্তিবাদী মানসিকতা দেখা যায়, 'বাংলায়  ইয়ংবেঙ্গল ডিরোজিও' গোষ্ঠী তীব্র যুক্তিবাদী দৃষ্টি ও প্রচলিত কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলনে তার প্রতিফলিত হয়। ৪শ্র কিছুটা প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি কিছুটা প্রতীয‍্য বিশেষত ইংল্যান্ডের সংস্কৃতির মিশ্রণ বাংলা

ইতালি রেনেসাঁস মানবতাবাদ আমরা রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে বিকশিত হতে দেখি। উপরক্ত যুক্তিতে উনিশ শতকের নবজাগরণকে অনেকে বাংলার রেনেসাঁস থাকেন। তবে অনেকে তীব্র আপত্তি করেন, তাদের মধ্যে বাংলার নবজাগরণকে কখনো কখনো প্রকৃত রেনেসাঁস বলা যায় না।

সম্প্রতি dr. Amlesh tripathi বলেছেন, বাংলার নবজাগরণের পেক্ষাপট ও প্রকৃতি সঙ্গে ইতালির রেনেসাঁসের তুলনা অর্থহীন। ১২ ও ১৩ শতকের বাণিজ্য বিপ্লব, নগর বিপ্লব প্রভৃতি অর্থসামাজিক পরিবর্তন ইতালিয় তথা ইউরোপীয় রেনেসাঁসের যে মজবুত ও ব‍্যাপক সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমি রচনা করে।

বাংলার নবজাগরণের পশ্চাতে সেই প্রেক্ষাপট ছিল অনুপস্থিত অশোক মিত্রের মতো চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদার সম্প্রদায় কৃষকের কাছ থেকে শোষিত অর্থে ধনশালী হয়ে কলকাতায় বসবাস করতেন। তারাই ছিলেন বাংলার নবজাগরণের পৃষ্ঠপোষক।

বাংলার নবজাগরণের বেশিরভাগ নায়ক ছিলেন সরকারি কর্মচারী। বিদ্যাসাগর ছিলেন প্রধান শিক্ষক। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীনচন্দ্র, রামলাল ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন ঠাকুর পরিবার। ঠাকুর পরিবার বাণিজ্য লক্ষীলাভ করেন। সুতরাং এর নায়কদের মধ্যে ফ্লোরেন্সের বুজুর্য়া শ্রেণি প্রতিছায়া খোঁজা নিষ্ফল এরা ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার ছাড়া আর কোন বলিষ্ট শিল্পে সাহিত্যকর্মে উদ্দ‍্যোগ নিতে সক্ষম ছিলেন না।

 বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে যে নতুন সৃষ্টির জোয়ার দেখা দেয়, তারা প্রেরণা মূলত ইংরেজি সাহিত্য থেকে। গ্রিক ও ল‍্যাটিনের সাহিত্য থেকে এই প্রেরণা আসেনি। সংস্কৃত সাহিত্য প্রভাব নিশ্চয় ছিল। একথা অবশ্যই বলা উচিত বঙ্গীয় রেনেসাঁসের রুপকাররা বিশেষ করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত সমন্বয়বাদিরা প্রাচীন ভারতে সংস্কৃত সাহিত্য দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিলেন। মোটকথা , বাংলার নবজাগরণের বীজ ছিল মিলার সাহিত্য কেবলমাত্র ইংরেজি সাহিত্যের দ্বারা প্রভাবিত ছিল না। তার প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃত সাহিত্যের দ্বারাও প্রভাবিত ছিল। 

ইউরোপীয় রেনেসাঁস :- 

 ইউরোপের ক্ষেত্রে নবজাগরণ শব্দটি ব্যবহার করা হয় না ব্যবহৃত হয় রেনেসাঁস বা পুর্নজাগরণ। ইউরোপের ক্ষেত্রে ধারাবাহিক জাগরণের পর এসেছে অন্ধকারময় যুগ। তারপর এসেছে রেনেসাঁস। প্রকৃতপক্ষে রেনেসাঁস মানুষের মননের যুক্তি রেনেসাঁস হলো ইউরোপীয় জীবনের সামগ্রিক পরিবর্তন। এই পরিবর্তন হল সাংস্কৃতিক, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটে যায় 

১| রেনেসাঁস বা নবজাগরণের সামাজিক ভিত্তি :-

একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সেখানে শিখা ছিল ধর্মকেন্দ্রিক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রসারের ফলে সাফিচার ও অন্যান্য ঐতিহাসিকের মতে, ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দের  বহু পূর্বে থেকেই ইউরোপে বিশেষ করে ইতালিতে একটি শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। এই শিক্ষিত সম্প্রদায় ছিল নবজাগরণের অগ্রদূত। মধ্যযুগের শেষদিকে ইউরোপে নানা স্থানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। 

প্রথমে ইতালির র‍্যাওলা, মিলান প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে প্যারিসে অক্সফোর্ড, কেন্দ্রিক, হ‍্যামবুর্গ প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। এর ফলে সাধারণ শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এর আগে গির্জায় ছিল ইউরোপেধারণ মানুষের মধ্যে শিক্ষার প্রসার হয় এই শিক্ষিত শ্রেণী বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অ্যারিস্টোটলের তর্ক শাস্ত্র ও দর্শন এবং গ্রিক ও আরবিয় দর্শন ও বিজ্ঞানের পাঠ নিয়ে মানুষের মনে যুক্তিবাদের বিকাশ ঘটতে থাকে।

 এই  আলোকে মধ্য যুগে প্রচলিত অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কারের কুসংস্কারকে আক্রমণ করে। টমাস অ‍্যাকুইনাস, রজারবেকন, প্রভৃতি ছিলেন এই শিক্ষিত শ্রেণীর পুরোধা। এদের সমালোচনার ফলে গির্জার প্রভাব কমতে থাকে। রজারবেকন বলেন, " সত্য কোন নির্দিষ্ট অপরিবর্তনীয় বিষয় নয়, এটা সময় অনুযায়ী পরিবর্তনশীল" এই শিক্ষিত শ্রেণী ও ধর্মযাজকদের চেষ্টার মধ্যযুগের বিদ্যালয়গুলিতে ল্যাটিন, সাহিত্য, আরবীর বিজ্ঞান এবং রোমান আইনের চর্চা চলে। এইভাবে রেনেসাঁস সামাজিক ভিত্তিভুমি আগেই তৈরি হয়।

 ২| ইউরোপীয় সমাজে রেনেসাঁসের প্রভাব:- 

 পঞ্চদশ শতকের শেষের দিকে ইতালিতে যে রেনেসাঁস বা নবজাগরণের প্রথম সূত্রপাত ঘটেছিল, তা কালক্রমে কমবেশি ইউরোপের সব দেশে বিস্তৃত লাভ করে। সমকালীন ইউরোপের সমাজ ব্যবস্থাকে নবজাগরণের ব্যাপক প্রভাবিত করেছিল। বস্তুত রেনেসাঁস ইউরোপীয় সমাজ জীবনে যথেষ্ট পরিবর্তন এনেছিল।

 মধ্যযুগীয় সমাজ ব্যবস্থা মানুষকে যেভাবে সামাজিক ও মানসিক ভাবে গ্রাস করে রেখেছিল তার যথেষ্ট পরিবর্তন ঘটল। মানুষ ক্রমশ যুক্তিবাদী হয়ে উঠল। যে ধর্মীয় কুসংস্কার এবং অন্ধ বিশ্বাস মানুষকে রুদ্ধ করে রেখেছিল, রেনেসাঁসের আলোকচ্ছটায় মানুষ তা থেকে মুক্তি পেল। রেনেসাঁসের আবির্ভাব এর ফলে গ্রিক সাহিত্যের উৎকর্ষতা প্রতি জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষিত হলো। 

 অপরদিকে ধীরে ধীরে পূর্বপ্রচলিত ইশ্বর তত্ত্ববিদ‍্যায় প্রচলিত হ্রাস পেতে থাকে। এককথায় ইউরোপীয় দেশগুলি গ্রিক সাহিত্যের অগ্রসর হতে থাকে। নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলে গ্রিক সাহিত্যনুশীলনের ব্যাপারে জনগণের আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পায়। জনগণের এই আকাঙ্ক্ষা কে বিখ্যাত গ্রিক শিক্ষাপ্রাপ্ত পণ্ডিতেরা প্রচারকার্যের মাধ্যমে বাস্তব বাস্তব রূপ দিয়েছিলেন।

 এইভাবে ইংল‍্যান্ড, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, ডেনমার্ক, ফ্রান্স ইত‍্যাদি দেশে প্রাচীন গ্রীক ও ল‍্যাটিন সাহিত্যনুশীলনের ব্যাপক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। আধুনিক সমাজের অগ্রগতিতে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। আগে মানুষ সাহিত্য, বিজ্ঞান - চর্চার ব্যাপারে উৎসাহী ছিল না। কিন্তু এখন নবজাগরণের প্রভাবে সাহিত্য ছাড়াও বিজ্ঞান, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে অতি আগ্রহ সহকারে পাঠ করতে থাকে। প্লেটো ও অ্যারিস্টোটলের দর্শন তত্ত্বের পুনরুদ্ধার ঘটার সাহিত্য সমৃদ্ধশীল হয়ে ওঠে। নতুন নতুন কবিতা, নাটক, সংগীত প্রভৃতির দিকে জনসাধারণের ঝোঁক ক্রমশ বাড়তে থাকে। 

এককথায় রেনেসাঁস সমাজের যাবতীয় কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস ইত্যাদি মধ্যযুগীয় চিন্তাভাবনাকে এবং সমাজ ব্যবস্থাকে গতিশীল করে তুলেছিল। কিন্তু সবকিছুর উপরে রেনেসাঁস ভালো প্রভাব পড়েছিল বলে মনে করলে ভুল হবে বস্তুত রেনেসাঁস জনিত জাগরনের ফলে পোপের অধিক আধিপত্য মুক্ত একটি সমাজ গড়তে গিয়ে জনগণ নৈতিক ভাবনীতির দিকে ধাবিত হয়। তাদের নৈতিকতার মান অনেক নেমে যায় আধিপত্যের অভাবে। 


কলকাতা কেন্দ্রিক নবজাগরণ ভাবনার বাইরে বেরোনোর প্রয়াস আজও উপক্ষিত থেকে গেল :- 

ঊনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ ভারত ইতিহাসে স্মরণীয় এক বর্ণময় জটিল অধ‍্যায়। নবজাগরণ "রেনেসাঁস" এর শব্দরূপ কিনা তার উৎপত্তি, বিস্তার, চরিত্র প্রভাব ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা গবেষণা ও বিতর্ক এক সমৃদ্ধ ইতিহাস চর্চার ঐতিহ্য তৈরি করেছে। ডেভিড কফ, বিনয় ঘোষ থেকে আরম্ভ করে প্রভৃতি ইতিহাসবিদ্ এই ঐতিহ্যকেই পুষ্ট করেছেন।

কলকাতার আনন্দমোহন কলেজের সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করার উপলক্ষে পরিকল্পিত অনুষ্টুপের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত বর্তমান সংকলনটিতে নবজাগরণের বিভিন্নতাকে ফিরে দেখার বা জানার চেষ্টা করা হয়েছে। আধুনিক ভারত চেতনার বিকাশের ইতিহাসকে বুঝতে হলে নবজাগরণের বহুমাত্রিক চরিত্র, রঙিন - বেরঙিন, বৈচিত্র্য ও জটিল প্রভাবকে নতুন করে চেনা দরকার এবং এই প্রেক্ষিতেই সে যুগের বিভিন্ন দিককে তুলে ধরার প্রয়াস হল এই সংকলন।

সংকলনটির প্রবন্ধগুলিকে নবজাগরণের প্রেক্ষিতে বিষায়ানুসারে ৯টি বিভাগে ভাগ করা হয়েছে। এবং ২৮টি রচনা এখানে স্থান পেয়েছে। যার মধ‍্যে ইংরেজিতে রয়েছে ৬টি। প্রথম ভাগে রয়েছে সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র, শুরু হয়েছে অভ্র ঘোষের ঊনিশ শতকের চর্চা দিয়ে। এবং বিশ শতক জুড়ে রয়েছে বিদ্যাসাগরের চর্চা ১৯৭০-এর দশকে নবজাগরণ মার্কসবাদী মূল‍্যায়ন, নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার নবজাগরণ ইত্যাদি ধারা পর্যালোচনা করে লেখক ঊনিশ শতকে চর্চার জটিলতা ও বহুমাত্রিকতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।

kolkata-kendric-nobojagoron



রাজকুমার চক্রবর্তী দেখিয়েছেন বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য প্রবাহ সাম্রাজ্য ব্যবস্থার অন্তর্গত একটি শহর হিসেবে কলকাতার উত্থানের দ্বারা সৃষ্টি নতুনতর মনন সংস্কৃতি নাগরিক সমাজের পরিসরে রামমোহন ও ডিরোজিওর দেশপ্রেম ও নেশন ভাবনা কী রুপ ধারণ করেছিল আর উত্তরকালের ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সাথে তার সাদৃশ্য এবং বৈসাদৃশ্যই বা কতটা ছিল।

কুন্তল চট্টোপাধ্যায় সমকালীন কলকাতার নাগরিক জীবনের চলচ্চিত্র খুঁজেছেন কালীপ্রসন্ন সিংহের "হুতুম প্যাঁচার নকশা" " ভারতীয় নেশন" ও জাতীয়তাবাদের ধারণার উদ্ভবকে বাংলার রেনেসাঁসের প্রেক্ষিতে ব‍্যাখ‍্যা করার প্রয়াস করেছেন যথা রোহিণী রায়চৌধুরী। এবং বলা যায় ইংরেজি ভাষায় প্রমোদ তাত্ত্বিক ভাবনার সীমাবদ্ধতা ও অপ্রতুল তথ্যসূত্রের কারনে লেখাটি সংকলন একটু বেমানান। দ্বিতীয় ভাগে আলোচিত হয়েছে নবজাগরণে কয়জন মানুষের ভাবনা, কর্ম, ও অবদান। 

১| সতীদাহ প্রথা বর্জন :- 

সমাজ - সংস্কারের ক্ষেত্রে রাম মোহনের শ্রেষ্ঠ ঘটনা হল সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধ আন্দোলন। এই সতীদাহ প্রথায় সাধারণত কোন নারীর স্বামীর মৃত্যু হলে স্বামীর চিতার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীকে সেই জ্বলন্ত চিতায় মৃত্যু বরণ করতে হত। 

 ২| ব্রাহ্মসমাজ গঠন:-

 বিশুদ্ধ একেশ্বরবাদের ভিত্তিতে উপাসনা রীতি প্রচারের উদ্দেশ্যে ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন " ব্রাহ্মসমাজ " নামে এক নতুন সভা স্থাপন করেন। এই সভায় বেদ, উপনিষদ- পাঠ ও ব্রাহ্ম - সঙ্গীত গাওয়া হত। এই সভায় একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ও মূর্তিপূজা - বিরোধী সব লোকের প্রবেশাধিকার ছিল। কিন্তু ব্রাহ্মসমাজকে কোন নতুন ধর্ম যুক্তিযুক্ত নয়। 

কুসংস্কারগ্রস্ত ও আচার-অনুষ্ঠান সর্বস্ব হিন্দু ধর্মের সংস্কার সাধন করাই ছিল রামমোহনের উদ্দেশ্য। ইত্যাদি কুসংস্কার থেকে হিন্দু সমাজকে আলোর পথ দেখান এজন্য হিন্দু সমাজে এবং ভারতীয় সমাজের রাজা রামমোহন রায়ের অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য এবং বাংলা নবজাগরণের ব্রাহ্ম সমাজের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। এবং ইশ্বরচন্দ্র বিদ‍্যা সাগরের বহু মুখি সংস্কার সাধনে তার ভাবনা, কর্ম ও বাংলার নবজাগরণে বিশেষ ভূমিকা ছিল। যেমন 

৩| বিধবা বিবাহ :- 

১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে জুলাই  লর্ড ডালহৌসী বিধবা বিবাহ সংক্রান্ত আইন পাশ করেন। বিধবা বিবাহ আইন সিদ্ধ হলেও তা কার্যকর করার সহজ ছিল না। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের এ বিষয়ে অটল ছিলেন। তিনি তার নিজ পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে এক বিধবা পাত্রীর বিবাহের আয়োজন করেন। এই ভাবে ঊনিশ শতকের সমাজ সংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আন্দোলন প্রথম সর্বভারতীয় এক আন্দোলন এর সূত্রপাত করে।

raja-ram-mohan-roy


 ৪| স্ত্রীশিক্ষা প্রচলন:- 

 তিনি উপলব্ধি করেন যে নারী জাতির উন্নতি না ঘটলে বাংলা সমাজ ও সংস্কৃতির প্রকৃত উন্নতি সম্ভব নয়। তাই তিনি ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বর্ধমান জেলায় মেয়েদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন স্কুলের নাম বেথুন স্কুল। বিদ্যাসাগরই ছিলেন এই বিদ্যালয়ের সম্পাদক। এরপর আরও বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন এভাবে তিনি স্ত্রীশিক্ষা প্রচলন করেন। এবং 

 ৫| বহু বিবাহ বাল্য বিবাহ:- 

এই প্রথা সম্পর্কে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কঠোর সমালোচনা করেন। এবং ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে এ সম্পর্কে দুটি পত্রিকায় প্রকাশ করেন বলেন যে বহু বিবাহ ও বাল্য বিবাহ প্রথাও হলো সমাজ সংস্কারে অমানবিক। ইত্যাদি কুসংস্কার থেকে ইশ্বরচন্দ্র বিদ‍্যাসাগর মানুষকে আলোর পথ দেখায়। তার ভাবনা, কর্ম, ও অবদান বাংলার নবজাগরণে অতুলনীয় । এবং আরও ঐতিহাসিক যেমন প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ডিরোজিওর ভাবাদর্শ ও জীবন প্রতীতির নানান দিক উল্লেখ করে তার সামাজিক সংশোধনকারী আন্দোলন মূল সত্যসন্ধানী প্রবণতা সৃষ্টি করেছেন।

রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য বিচার করেছেন প্যারীচাঁদ মিত্রের "আলালের ঘরের দুলাল" ইত্যাদি ঐতিহাসিক এর বাংলার নবজাগরণের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। সংকলনের তৃতীয়ভাগে আছে এই প্রসঙ্গের তিন টি নিবন্ধ। এবং নবজাগরণের নারীর অবস্থান নিয়ে স্থান পেয়েছে দুটি প্রবন্ধ। প্রথমটি সোহিনি ঘোষ খুঁজেছেন উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি নারীর আকাঙ্ক্ষা, আত্মসম্মানবোধ, স্বাতন্ত্র, স্বাধীনতা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিত।
 
নবজাগরণ কালের ভাষা, দর্শন ও সংস্কৃতি নিয়ে সাধারণত চারটি প্রবন্ধ সংকলন এসেছে। এবং এখানে নবজাগরণের "রেনেসাঁস " নামকরণ বিতর্কে দৃষ্টিপাত করেছেন পলাশ বরণ পাল। সংকলনটি শেষের কথায় গীতশ্রী সরকারের বিশ্বায়নের প্রেক্ষিতে নতুন প্রজন্মের নবজাগরণের ভাবনা বিচারে কিছুটা প্রতিফলিত হয়েছে।

এখানে লেখিকা প্রশ্ন তুলেছেন বর্তমান প্রজন্মের নবজাগরণ সম্পর্কে- বিচ‍্যুতি কি এক বৃহত রাষ্ট্রের প্রকল্পের অন্তর্গত? নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতিতে বিশ্বায়নের ফলে আমাদের ইতিহাস বিচ্ছিন্নতা শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস কে ভুলিয়ে বস্তুবাদী ভোগকেন্দ্রিক অনুগত নাগরিক তৈরী করে মাত্র। প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ।অনুষ্টুপ -এর মতে প্রকাশনার কাছ থেকে বাংলার নবজাগরণের ইতিহাসকে ফিরে দেখা নিয়ে সংকলনে কিছুটা প্রত্যাশা থাকা স্বাভাবিক। 


গুণমানের সঙ্গে পরিমাণ মেলানোর চেষ্টা ও হয়তো সেই প্রত্যাশায় আগেই হোঁচট খেতে হয়। দু-একটি ইংরেজি নিবন্ধে ভাষাগত প্রমোদ বেশ দৃষ্টি কটু। অপরদিকে মুখবন্ধে নবজাগরণের ভৌগোলিক মাত্রার কথা বলা হয়ে থাকলেও দুর্ভাগ্যবশত সংকলনের শিরোনাম তার সহজবোধ্য প্রতিফলন ঘটেনি। এমনকি দু-একটি ব্যাতিক্রম ছাড়া নিবন্ধ গুলিতেও কলকাতাকেন্দ্রিক নবজাগরণ ভাবনার বাইরে বেরোনোর প্রয়োগ দেখা যায়নি। গান ও খেলার মতো বিষয়কে এখানেও নবজাগরণের পুর্ননির্মাণে না দেখার আক্ষেপ থেকেই যায়। 


বাংলা নবজাগরণ ছিল কলকাতা শহর কেন্দ্রিক মন্তব্যটি বিশ্লেষণ :- 

পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে এসে ঊনিশ শতকের মধ্যবিত্ত সমাজে যে আধুনিক মনোভাবাপন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দেখা দিয়েছিল যার ভিত্তি ছিল যুক্তি ও মানবতাবাদ। সাধারণত ঊনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের ব‍্যাপ্তি বা পরিসর খুবই সীমিত ছিল। এটি ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক, বিশেষ করে বলা হয়ে থাকে বাংলা নবজাগরণ ছিল কলকাতার কেন্দ্রিক। 

এই নবজাগরণ কলকাতার বাইরে গ্রাম বাংলায় এর প্রসার তেমন ঘটেনি এবং গ্রাম বাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর এর জনগণের কোনো সুফল পায়নি। বাংলার জাগরণ শুধু পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত প্রগতিশীল সমাজেই সীমাবদ্ধ ছিল। যাদের মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক বলা হয়। 

এই কারণে অধ্যাপক অনিল শীল কলকাতাকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের এই নবজাগরণকে "এলিটিস্ট আন্দোলন" বলেছেন। কলকাতা নবজাগরণের যে ঢেউ আছড়ে পড়েছিল তার ছিটেফোঁটাও গ্রামবাংলায় পরিলক্ষিত হয়নি। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের সেন্সাস কমিশনার অশোক মিত্র সেন্সাস রিপোর্টে এটি তাই " So Called Renaissance " বলেছেন। 


বাংলায় নবজাগরণের বৈশিষ্ট্য:- 

বাংলার ইতিহাসে নবজাগরণের অবদান সত‍্যই অনুস্বীকার্য। এই নবজাগরণ আমাদের পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করে আধুনিক চিন্তাধারার উদ্ভূত করল। বাংলার নবজাগরণ এর কিছু বৈশিষ্ট্য নিম্নে আলোচনা করা হল। যথা- 

১| কুসংস্কার:- 

ঊনিশ শতকের এই নবজাগরণ সাধারন মানুষকে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রদান করে মানুষের মন থেকে নানা ধরনের কুসংস্কার দূরীভূত করে। এবং এক আধুনিক চিন্তা ধারার জন্ম দেয়। 

২| নবজাগরণের তৃতীয় শ্রেণীর উদ্ভব:- 

বাংলা নবজাগরণ একটি তৃতীয় ধারার' উদ্ভব হয় যাকে আমরা সমন্বয়বাদি ধারা বলতে পারি। প্রাচীন যুগে যা কিছু শ্রেষ্ঠ ও যুক্তিসিদ্ধ তার সঙ্গে প্রতিচ‍্যের জ্ঞান বিজ্ঞানের যা কিছু শ্রেষ্ঠ সমন্বয়ের দ্বারা বাংলা তথা ভারতের ভবিষ্যতের অগ্রগতির পথ নির্দেশ ছিল এই ধারার বৈশিষ্ট্য। এর প্রধান প্রবক্তা ছিলেন আধুনিক ভারতের জনক ভারত পথিক রামমোহন রায়। 


নবজাগরণের ত্রুটি :-

নবজাগরণ যেভাবে বাংলাদেশে আছড়ে পড়েছিল তার সুদূর প্রসারী ফল পরিলক্ষিত হয় না। পরবর্তীকালে দেখা যায় নবজাগরণ ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের গড়ে উঠতে থাকে। ডিভিয়ান ডিরোজিওর ইয়ংবেঙ্গল দল নবজাগরণ প্রভাবকে অন্য একটি স্তরে নিয়ে চলে যায়। উগ্র আধুনিকতা, উগ্র জাতীয়তাবোধ স্বদেশ প্রেম সমাজ তথা দেশকে এক ভয়ংকর পরিণতির পথে নিয়ে যেতে থাকে। 

জাতীয়তাবোধের উগ্রতা ক্রমে ক্রমে সাম্রাজ্যবাদের পথকে প্রশস্ত করতে থাকে। যার পরিণতি হলো ভয়ঙ্কর। সুতরাং নবজাগরণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ত্রুটি ছিল। নবজাগরণ কোন সীমাবদ্ধতা মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি। এর কোন নিয়ন্ত্রন ছিল না। তাই বিভিন্ন ব্যাক্তিবর্গ ভিন্ন ভিন্ন রূপে নিজেদের স্বার্থে নবজাগরণকে ব্যবহার করতে থাকে। 

সুতরাং নবজাগরণ বিষয়টি জনসমাজকে নতুন পথে পরিচালিত করলেও এর ত্রুটি - বিচ‍্যুতির ফলে শিক্ষা, সমাজ, রাজনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। 

অনুকূল পরিস্থিতি অভাব :-

বাংলাদেশে ধনী ভূস্বামী শ্রেণি ব্রিটিশ শাসনের ছত্রছায়ায় নবজাগরণ এর সূত্রপাত ঘটেছিল। তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ও পাশ্চাত্য ভাবাদর্শে বিশ্বাসী মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। বাংলায় নবজাগরণে সামন্ততন্ত্রের জায়গায় বুর্জোয়া ধনতন্ত্রের উত্তরণের কোন প্রয়াস ছিল না। আসলে এই ধরনের উত্তরণের অনূকুল কোনো সামাজিক পরিস্থিতি এই সময় বাংলায় ছিল না। 
 

 নবজাগরণের সীমাবদ্ধতা :-

 উনিশ শতকের নবজাগরণ হিন্দু সমাজের সীমিত পরিসরের মধ্যে একটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করলোও তা কোন ব্যাপক আন্দোলন বা মৌলিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে আনতে পারেননি। এর নেতারা আবেদন করেছিলেন মানুষের বুদ্ধি ও চিন্তার কাছে, মানুষের হৃদয়তন্ত্রীতে তারা ঝংকার তুলতে পারেননি। ফলে তাদের অধিকাংশ আন্দোলনই খুব একটা সফল হতে পারেননি।


এছাড়া বিভিন্ন ব্যাক্তিবর্গ নিজ নিজ স্বার্থে নবজাগরণ কে ব্যবহার করেছিল। হিন্দু ধর্মের প্রবক্তা নবজাগরণকে নিজধর্মের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে নবজাগরণকে সংকীর্ণ করে তুলেছিল। পাশাপাশি মুসলিম সমাজের প্রবক্তারা নবজাগরণকে ব্যক্তিগত স্বার্থে প্রয়োগ করেছিল। এবং এইভাবে নবজাগরণ একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। এর ফলে নবজাগরণ সকলশ্রেণীর সমাজ তথা মানব জাতির কল্যাণ কে ত্বরান্বিত করতে পারেননি। 

 

গুরুত্ব :- 

উপরিক্ত আলোচনা থেকে আমরা বলতে পারি যে নানা দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও ঊনিশ শতকের নবজাগরণের ফলে মানুষের মন থেকে জাতি, ধর্ম, আত্মবিশ্বাস, এবং হিন্দু সমাজে বিভিন্ন প্রকার কুসংস্কার ইত্যাদি থেকে এই নবজাগরণ বাংলায় এক নতুন আলোর পথ দেখায়। 

সুতরাং বলা যায় আদ‍্যিকালের ধ‍্যান - ধারণা থেকে নতুন পথের সন্ধান দেয়। তাই বাংলায় নবজাগরণের গুরুত্ব অপরিসীম। ঊনিশ শতকের বাংলার এই নবজাগরণ আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।

Source:[Wikipedia];[Byjus.com];[source]









একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ